প্রুফ রিডার

 

প্রকাশান শিল্পের সাথে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশে প্রুফরিডিং। নিজের সৃজনশীলতা দেখানোর অফুরন্ত সুযোগ আছে এই পেশায়। প্রুফরিডার হিসাবে কাজের সুযোগ রয়েছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা, সংবাদপত্র প্রকাশনা সংস্থায়। 

 

প্রুফ রিডার

 

প্রুফ রিডার কে?

প্রুফ ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ সংশোধন। গ্রন্থ, পুস্তিকা, পত্রিকা, ম্যাগাজিন বা যেকোনো কম্পোজে বা লেখায় বিদ্যমান ত্রুটি দূর করে লেখা নির্ভুল করাকে প্রুফ বলে।  প্রুফ রিডিংয়ের আভিধানিক অর্থ হল ‘প্রুফ সংশোধন’। তবে ‘প্রুফ সংশোধন’ শব্দবন্ধের ব্যবহার নেই তাই সার্বজনীন ভাবে একে প্রুফ রিডিং বলা হয়। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি হোক আর কম্পোজ করাই হোক, প্রায়শই লেখাতে ভুল থাকে। এই ভুলগুলো শুধরানোর কাজ করেন যিনি, তিনিই হলেন প্রুফ রিডার।

প্রুফ রিডিং করতে হলে লেখাটি পড়তে হয় এবং প্রমিত বা মান ভাষা সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকতে হয়। একজন প্রুফ রিডার একটি নির্ভুল প্রকাশনায় সহায়তা করেন।

 

দায়িত্ব

সম্পাদনার একেবারে সর্বশেষ ধাপ প্রুফ এডিটিং। তাই কাজটা অনেক স্পর্শকাতর। কারণ, ছাপা হয়ে গেলে আর সংশোধনের সুযোগ থাকে না। ভুল বানান বা এই জাতীয় অন্য কোন ভুল ভ্রান্তি পাঠকের কাছে সেই প্রকাশনার বিশ্বাসযোগ্যতাকে বিনষ্ট করে ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও ওঠে।

পাঠকের কাছে ভুল বার্তা তুলে ধরে একই সাথে নবীন পাঠকদের কাছে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তাই ভুল প্রকাশনা মানেই পাঠকের ক্ষতির সাথে সাথে প্রকাশনার বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতিও বটে।

এই সকল বিষয়কে মাথায় রেখে বলা যেতেই পারে যে কোন প্রকাশনার ক্ষেত্রেই প্রুফ সংশোধন আবশ্যিক।

 

কাজের সুযোগ

বিশ্বের অনেক ভাষায় প্রুফ রিডিংয়ের কাজ বর্তমানে কম্পিউটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) বা এআই এর মাধ্যমে করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এক এক প্রতিষ্ঠান এক এক বানানরীতি অনুসরণ করে। লেখকরাও ভিন্ন ভিন্ন বানান রীতি অনুসরণ করেন। ফলে আমাদের দেশে প্রুফ রিডিংয়ের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।

প্রুফ রিডারকে কোন লেখক এবং প্রতিষ্ঠানের বানানরীতি অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোয় প্রুফ রিডারদের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কারণ, সেখানে কারিগরি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। লেখা কম্পিউটার বা ওয়ার্ড ফাইলে নেওয়ার সময় ভেঙে যায়, সেগুলো সঠিকভাবে সম্পাদনার জন্য প্রুফ রিডার দরকার।

বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা ছাড়া প্রুফ রিডার হিসেবে কাজের সুযোগ রয়েছে সংবাদপত্র, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে। এ ছাড়া প্রোডাকশন হাউসগুলোয় নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন ধরনের পাণ্ডুলিপি সংশোধনের জন্য প্রুফ রিডার নিয়োগ দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও কনটেন্ট রাইটিং সংস্থায়ও এই পেশায় দক্ষ জনবল দরকার হয়।

প্রুফ রিডার নিয়োগের জন্য গণমাধ্যম কিংবা চাকরির ওয়েবসাইটে খুব বেশি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। পরিচিতজনদের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা এই পেশায় আসতে চান, তাঁদের বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।

 

যোগ্যতা

অবশ্যই যে ভাষায় লেখা প্রুফ করতে হবে সে সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। সবচেয়ে বেশি বানান-সম্পর্কিত জ্ঞানের ওপর জোর দিতে হবে। ব্যাকরণ বিষয়ে ধারণা থাকলে আনুষঙ্গিক ভুলও সংশোধনে সাহায্য করতে পারা যায়।

প্রুফ রিডিংয়ে ভালো করতে চাইলে সাহিত্যবিষয়ক বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ পেশায় সার্টিফিকেটের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। নিয়মিত অভিধান পড়তে হবে, যেন প্রয়োজনের সময় দ্রুত সঠিক বানানটি বের করা যায়।

প্রুফ রিডার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে নিজের জানাশোনার আগ্রহ থাকা দরকার। শুদ্ধ করে বানান লেখার খুঁটিনাটি বিষয় আয়ত্তে রাখতে হবে। বানানের ক্ল্যাসিক ও আধুনিক ফরম্যাট সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।

প্রুফ রিডার হতে গেলে কতকগুলি অতিআবশ্যিক গুনাগুণ থাকতে হয়। সেগুলো হলে:

  • পেশাগত জ্ঞান।
  • ব্যকরণের উপর বিশেষ দক্ষতা।
  • ভাষার উপর দক্ষতা ( যে ভাষায় তিনি প্রুফ রিডিং করবেন)
  • বানান সম্পর্কে অতি সচেতন।
  • সম্পাদনার জ্ঞান।
  • বাক্য সংগঠনের জ্ঞান।

প্রুফ সংশোধনের নিয়মা

১৮৫৮ সালের ১২ই জুলাই ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউট, যার বর্তমান নাম বিউরো অফ ইন্ডিয়া স্ট্যানডার্ডস (Bureau of Indian Standards) বা বিআইএস আলোচনা এবং বিতর্কের মাধ্যমে প্রুফ সংশোধনের নিয়মাবলীর কথা বলেছে।

মূলত এই নির্দিষ্ট নিয়ম ক্ষেত্রেই প্রকাশক, মুদ্রক, লেখকরা প্রুফ সংশোধন করে থাকেন। অবশ্য নিজেদের প্রয়োজনে একটুখানি অদল বদল ঘটালে অন্য কথা।

মুদ্রণ পদ্ধতির বদল ঘটলেও প্রুফ সংশোধনের চিহ্ণের পরিবর্তন কিন্তু হয়নি। বিআইএস নিয়মানুসারে প্রুফ সংশোধনের ভাগগুলি হল-

  • সাধারণ (General)
  • যতিচিহ্ন (Punctuation)
  • স্থানের কমানো বাড়ানো (Spacing)
  • সমতা (Alignment )
  • হরফ (Type)

 

প্রুফ রিডারের কাজ:

সংবাদপত্র, পত্রিকা, বই বা এ জাতীয় মুদ্রণ প্রকাশনার ক্ষেত্রে ছাপার আগে কম্পোজিং এ কোন ভুল ভ্রান্তি আছে কিনা যাচাই করে, বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে, নির্ধারিত প্রুফ রিডিং সংকেত ব্যবহার করে প্রুফ রিডিং করে সংশোধন করা হয় । এখন অবশ্য বিভিন্ন সফটওয়ার এই ভুল সংশোধনে সহায়তা করে। প্রুফ রিডিংয়ের জন্য যেসব করা করা হয় তা হলো:

  • ভুল যতি-চিহ্ন, অথবা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যতি-চিহ্ন যদি বাদ পড়ে যায়।
  • ভুল বানান । বাংলা বানানের ক্ষেত্রে আর একটি বড় করে দেখার বিষয় হল ঐক্যবদ্ধ বানান (Uniformed spelling) একই বইতে একই বানান নানাভাবে লেখা উচিত নয়।
  • উলটে যাওয়া অক্ষর অযথা অপ্রয়োজনীয় / অতিরিক্ত কোন অক্ষর।
  • একটি শব্দের বিভিন্ন অক্ষরের মধ্যে ফাঁক থাকা বা দুটি শব্দের মধ্যে প্রয়োজনীয় ফাঁক না থাকা বা অতিমাত্রায় ফাঁক থাকা।
  • মূল লেখার কিছু অংশ বাদ যাওয়া।
  • এক রকম টেইপের সঙ্গে অন্য রকম টাইপ মিশে যাওয়া বা এক পয়েন্টের টাইপের মধ্যে অন্য পয়েন্টের টাইপ আসা, একে বলে Wrong fount (wf)।
  • তারিখ ও সালের গোলমাল।
  • একই শব্দ বা বাক্য দুবার কম্পোজ হওয়া।
  • ইংরাজি টাইপের ক্ষেত্রে ক্যাপিটালের বদলে স্মল ও স্মলের বদলে ক্যাপিটাল।
  • প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইটালিক শব্দ না বসানো।
  • প্যারাগ্রাফ না ভেঙে দীর্ঘ প্যারাগ্রাফ করা।
  • পাতার ভুল নম্বর বসানো।

 

আয়রোজগার

বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থারগুলোতে মাসিক ও চুক্তি ভিত্তিতে প্রুফ রিডার নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফর্মাভিত্তিক হিসেবেও কাজ দেওয়া হয়। মাসিক বেতন সাধারণত ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়। যাঁর কাজ যত ভালো, তাঁর আয় তত বেশি। ভালো কাজ করে কেউ কেউ মাসে ৬০-৭০ হাজার টাকাও আয় করেন। আর ফর্মাভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন প্রতি ফর্মা ২০০ টাকা দেওয়া হয়। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রতি ফর্মা এক হাজার টাকাও দেওয়া হয়। গবেষণাধর্মী বইগুলোর ক্ষেত্রে প্রুফ রিডারদের আয় অনেক বেশি হয়। কারণ, সেগুলোর পৃষ্ঠা বেশি এবং অনেক তথ্য থাকে। এসব সংশোধনের জন্য অভিজ্ঞ প্রুফ রিডার দরকার পড়ে।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *