শিক্ষকতা করা মানে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করা। এটা এক মহান পেশা। যার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো পেশার তুলনা হয় না। আর এই মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের একটি সনদ দেওয়া হবে, যে সনদের সাহায্যে পরবর্তী সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করা যাবে। বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে গেলে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ২০০৫ সাল থেকে এনটিআরসিএ এই পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে। আগে এই সনদের মেয়াদ পাঁচ বছর থাকলেও ২০১৩ সালের ১৩ জুন সনদের মেয়াদ আজীবন করে সরকার
আবেদনের যোগ্যতা
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হলে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক পাস হতে হবে। তবে সারা শিক্ষাজীবনে যে কোনো একটি মাত্র তৃতীয় বিভাগ বা সমমনা জিপিএর ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে সদ্য উত্তীর্ণ প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের প্রশংসাপত্র, টেবুলেশন শিট বা নম্বরপত্র, প্রবেশপত্রসহ আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু পরীক্ষায় অবতীর্ণ প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবেন না।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রস্তুতি
বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যারা কাজ করতে চান তাদের জন্য বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রিলিমিনারি পরীক্ষা
এমসিকিউ পদ্ধতিতে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। পরীক্ষার সময় থাকবে এক ঘণ্টা। বিষয় থাকবে মোট চারটি। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান। প্রতিটি বিষয়ে ২৫টি করে মোট ১০০টি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন থাকবে। প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য শূন্য দশমিক ৫০ নম্বর কাটা হবে। এরপর ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। পাস নম্বর ৪০।
লিখিত পরীক্ষা
প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ঐচ্ছিক বিষয়ের ওপর ১০০ নম্বরের তিন ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। স্কুল পর্যায়ের জন্য নবম-দশম শ্রেণির বইগুলো পড়তে হবে এবং কলেজ পর্যায়ের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হলে অনার্স পর্যায়ের বইগুলো পড়লেই চলবে। এ ছাড়া বিগত বছরের প্রশ্ন দেখলেও ধারণা পাওয়া যাবে। লিখিত পরীক্ষায় রচনামূলক প্রশ্ন থাকে পাঁচটি। প্রতিটি প্রশ্নের মান থাকে ১৫। সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন থাকবে পাঁচটি। প্রতিটি প্রশ্নেরই বিকল্প প্রশ্ন থাকবে।
বাংলা
স্কুল ও স্কুল পর্যায় ২-এ বাংলা অংশে ভালো করতে হলে ব্যাকরণে জোর দিতে হবে। ব্যাকরণের প্রায় প্রতিটি অধ্যায় থেকে এক থেকে দুটি প্রশ্ন আসে। এর মধ্যে ভাষারীতি ও বিরাম চিহ্নের ব্যবহার, বাগধারা ও বাগবিধি, ভুল সংশোধন বা শুদ্ধিকরণ, অনুবাদ, সন্ধিবিচ্ছেদ, কারক, বিভক্তি, সমাস ও প্রত্যয়, সমার্থক ও বিপরীতধর্মী শব্দ, বাক্য সংকোচন, লিঙ্গ পরিবর্তন অধ্যায়গুলো ভালোভাবে পড়লে প্রশ্ন পাওয়া যাবে। আর কলেজ পর্যায়ের জন্য পড়তে হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইগুলো। এসব বইয়ের গদ্য ও পদ্যের লেখক পরিচিতি সম্পর্কে জানা থাকলে ভালো করা যাবে। এ ছাড়া বিগত বছরের পরীক্ষার প্রশ্নের সমাধান করলেও বেশ কাজে দেবে।
ইংরেজি
ইংরেজি বিষয়ে বেশি করে পড়তে হবে গ্রামারের খুঁটিনাটি। এ অংশে ভালো করতে হলে গ্রামার অংশকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই গ্রামার অংশ থেকেই স্কুল ও কলেজ উভয় পর্যায়েই প্রশ্ন আসে। Completing Sentences, Translation from Bengali to English, Change of Parts of Speech, Right Forms of Verb, Fill in the Blanks with Appropriate Word, Transformation of Sentences, Synonyms and Antonyms, Idioms and Phrases, Article – এই অধ্যায়গুলো মনোযোগ সহকারে পড়লে প্রশ্ন পাওয়া যাবে।
গণিত
গণিতে ভালো করতে হলে সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির বইগুলো বারবার চর্চা করতে হবে। পাটিগণিত থেকে লসাগু, গসাগু, ঐকিক নিয়ম, শতকরা, সুদকষা, লাভ-তি, অনুপাত-সমানুপাত – এসব অধ্যায় ভালো করে চর্চা করলে প্রশ্ন পাওয়া যাবে। আর বীজগণিতের জন্য করতে হবে উৎপাদক, বর্গ ও ঘণসংবলিত সূত্রগুলো ও প্রয়োগ, গসাগু, সূচক, লগারিদম – এসব অধ্যায় থেকে প্রতি বছরই প্রশ্ন থাকে। জ্যামিতির জন্য রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, ক্ষেত্রফল ও বৃত্ত অধ্যায়গুলো আয়ত্তে রাখা দরকার। কলেজ পর্যায়ের জন্য পড়তে হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বই। বিগত বছরগুলোর বিসিএস প্রশ্ন ও শিক্ষক নিবন্ধন প্রশ্নগুলো বারবার চর্চা করলেও ভালো করা যাবে। প্রতিটি উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে।
সাধারণ জ্ঞান
সাধারণ জ্ঞানের অংশে ২৫টি প্রশ্ন থাকবে। এ অংশে ভালো করতে হলে নিয়মিত পত্রিকা পড়া, দেশি-বিদেশি সমসাময়িক খবরগুলো নিজের আয়ত্তে করে নেওয়া। বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি, পরিবেশ এবং রোগব্যাধি সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। বাংলাদেশ অংশে বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, জলবায়ু, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিভিন্ন জেলার আয়তন, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে অবগত থাকা। আর আন্তর্জাতিক অংশের জন্য বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, দিবস, পুরস্কার ও সম্মাননা, সাম্প্রতিক ঘটনা এসব থেকে দুই থেকে চারটি প্রশ্ন পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া বাজারে সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন প্রকাশনীর বই পড়লেও ভালো করা যাবে।
নিয়োগ পদ্ধতি
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রণীত মেধাতালিকা থেকেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে – এমন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। বর্তমান নিয়মে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পাচ্ছেন না। ফলে নিবন্ধন পরীক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ বিষয়টি বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন এ পরিকল্পনা। এনটিআরসি-এর তথ্য অনুযায়ী, এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরভিত্তিক শূন্যপদের সংখ্যা নিরূপণ, শূন্যপদের সংখ্যা অনুযায়ী লিখিত নিবন্ধন পরীক্ষার পর নির্ধারিত নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে উপজেলা, জেলা ও জাতীয়ভিত্তিক মেধাতালিকা করবে। এরপর মেধাক্রম ও চাহিদা অনুযায়ী প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশ করবে। স্কুল-কলেজ পরিচালনা কমিটি শুধু যোগদানপত্র দেবে। তবে কোনো প্রার্থী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পৃথকভাবে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ নম্বর না পেলে মেধাতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না।
এই লেখাটি “হতে চাইলে মানুষ গড়ার কারিগর” এই শিরোনামে দৈনিক আমাদের সময়ের ক্যারিয়ার সময় পাতায় ২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।
Leave a Reply