নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং

নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং বা Naval Architecture & Offshore Engineering (NAOE) বিষয়টি কিছুটা অপরিচিত হলেও বর্তমানে এর প্রয়োজনীয়তা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিন্তারিত: শামস্ বিশ্বাস

দেশকে ‘ব্লু ইকোনমি’ এগিয়ে নিতে মেরিটাইম সেক্টরে প্রচুর জনশক্তি দরকার যার পরিকল্পনা করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমআরএমইউ)  যাত্রা। বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র জয়ের পর আমরা বিশাল একটি অংশ পেয়েছি যাতে ধারণা করা হয় প্রচুর খনিজ রয়েছে কিন্তু দক্ষ জনশক্তি ও মেধার অভাবে আমরা এগুলো সঠিক ব্যবহার করতে পারছিনা। এজন্যই এখন বাংলাদেশে অফশোর ইঞ্জিনিয়ারের প্রচুর চাহিদা। দেশের দক্ষজনশক্তি খুলবে এই সম্ভাবনায় ভরা ক্ষেত্র। বাংলাদেশ জাহাজ তৈরি করে রপ্তানি করতে শুরু করেছে। একটি বিশ্বমানের আধুনিক জাহাজ তৈরির জন্য অবশ্যই প্রয়োজন একজন দক্ষ নেভাল আর্কিটেক্টকে। দেশের শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর এখন এই লক্ষ্যে প্রচুর পরিমাণ দক্ষ আর্কিটেক্ট দরকার যারা বিশ্বের বাজারে আমাদের তৈরি করা জাহাজ তুলে ধরবে। নেভাল আর্কিটেকচার এন্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে সফল্য অবধারিত।

নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং কী?

নেভাল আর্কিটেকচার বা নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকৌশলবিদ্যার এমন এক শাখা যেখানে আলোচনা করা হয় বিভিন্ন ধরনের নৌযানের স্থাপত্য, শিল্প, অবকাঠামো তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ, এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান নিয়ে।

সহজ ভাবে বললে, ডিঙি নৌকা থেকে শুরু করে রণতরী এই ভাসমানবস্তু (floating object) গুলোকে তৈরি থেকে শুরু করে পানিতে ঠিকঠাক ভাবে ভাসমান রাখার কাজই হলনৌ স্থাপত্যবিদ্যায়। নেভাল আর্কিটেক্টরা একটি জাহাজের (vessel) ডিজাইন থেকে শুরু করে এর নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, তদারকি ইত্যাদি সবকিছুই করে থাকেন। একটি অত্যাধুনিক যাত্রী জাহাজ থেকে শুরু করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সবই নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং তদারকিদে নেভাল আর্কিটেক্টদের থাকতে হয়।

বাংলাদেশে ‘অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং’ নাম খুবই নতুন। দেশে বর্তমানে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। ধরুন, সমুদ্রে তলদেশে কোনো এক জায়গায় জরিপ করে মূল্যবান তেল-গ্যাস এর সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন অফশোর ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন উত্তাল সমুদ্রের ভেতর থেকে নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য থেকে এগুলোকে উঠিয়ে আনা। অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূলনীতিই হচ্ছে সমুদ্রে কোনো শক্তিশালী স্ট্রাকচার তৈরি করে সেটার মাধ্যমে মূল্যবান খনিজ পানির উপরে উঠিয়ে আনা এবং সে সম্পর্কিত গবেষণা অভিযান চালানো।

কেন নেভাল আর্কিটেকচার এবং অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং?

নেভাল আর্কিটেকচার এবং অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে একইসাথে একজন আর্কিটেক্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার দুটো হবারই সুযোগ থাকছে। এই সাবজেক্টে পড়ে সুযোগ রয়েছে: নেভাল আর্কিটেক্ট, অফশোর ইঞ্জিনিয়ার, ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, সবসি ইঞ্জিনিয়ার, প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার, প্রজেক্ট ম্যানেজারসহ আরো অনেক কিছু যা নির্ভর করে আপনার স্কিলের উপর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাবজেক্টে পড়ানোই হয় এমনভাবে যাতে আপনি একজন দক্ষ নৌ প্রকৌশলী হওয়ার পাশাপাশি হতে পারেন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার।

বিভাগের জয়যাত্রা

সমুদ্রসীমায় যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্লু ইকোনমির মূল চালিকা শক্তি হলো বিভিন্ন ধরনের জাহাজ ও অফশোর কাঠামো। ব্লু ইকোনমি কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রকৌশল শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকৌশল ডিগ্রি দেওয়া হয়। নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টি বাংলাদেশে আরও ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হলেও, সমুদ্রসীমায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যে প্রকৌশল বিভাগ জড়িত থাকে তা হলো, ‘নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং’। এ বিষয়টি শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

পঠন-পাঠন

বিভাগের নাম নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং হলেও এটি মোটেও আর্কিটেকচার সাবজেক্ট নয়; বরং পরিপূর্ণ প্রকৌশল বিভাগ। এই বিভাগে আর্কিটেকচারটাও ইঞ্জিনিয়ারিং আর্কিটেকচার। স্ট্যাবিলিটি, কাঠামো নির্মাণ, প্রোপালশন সিস্টেমের মতো বেসিক নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে ফায়ার সেফটি, প্যাসেঞ্জার সেফটি, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, পলুশন প্রিভেনশন, ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম ডিজাইন, কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো মূল ডিজাইনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিএসএমআরএমইউর নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কোর্স কারিকুলাম যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানের। এর মাধ্যমে ছাত্ররা মৌলিক জ্ঞানসহ বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। এতে করে পেশাদারি জীবনে নিজেকে একজন আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ প্রকৌশলী রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন তাঁরা।  বিভিন্ন ল্যাবে হাতেকলমে প্রজেক্টের কাজ করানো হয়। তৃতীয় বর্ষ শেষে ছাত্রছাত্রীদের ২১ দিনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হয়, যা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত শিপইয়ার্ডগুলোতে সম্পাদন করা হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক তিনটি সার্টিফিকেট ট্রেনিং কোর্স করতে হয়, যেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের শিপ ডিজাইন সফটওয়্যার হাতেকলমে শেখার সুযোগ পায়।

গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা

গবেষণার জন্য এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণাক্ষেত্র জয় করা সমুদ্রের মতো বিশাল। জাহাজের ডিজাইন কনস্ট্রাকশন অপটিমাইজেশন, অফশোর স্ট্রাকচার উন্নয়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এনার্জি এফিসিয়েন্ট শিপ ডিজাইন, জিরো এমিশন শিপ ডিজাইন, অফশোর স্ট্রাকচার লোডিং অ্যান্ড স্ট্রেস অ্যানালাইসিস, ফেটিগ অ্যানালাইসিস, অয়েল রিগ, উইন্ড টারবাইন, ওয়েভ এনার্জি কনভারটার, উইন্ড এনার্জি হারনেসিং, সিএফডি সিমুলেশনের মাধ্যমে ফ্লুইড ফ্লো অ্যানালাইসিস, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেরিটাইম সেফটি ও রিস্ক অ্যানালাইসিস, মেরিনে পলুশন প্রিভেনশনসহ নানাবিধ গবেষণা ক্ষেত্র উন্মুক্ত।

উচ্চ শিক্ষার জন্য এই বিভাগের জন্য রয়েছে অবারিত সুযোগ। বিএসএমআরএমইউতে বর্তমানে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত পাঠদান করা হলেও অদূর ভবিষ্যতে এখানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করা হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ওই বিষয়ের ওপর মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা যায়। দেশের বাইরে এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি। কারণ জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, আমেরিকা, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলো জাহাজ নির্মাণ ও অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী হওয়ায় সেখানে রয়েছে অবারিত সম্ভাবনা।

চাকরির সুযোগ

জনশ্রুতি রয়েছে, নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাস করে বের হওয়র আগেই অর্থৎ শিক্ষার্থীর চাকরির রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই চাকরি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বিভাগ থেকে পাশকরা শিক্ষার্থীরা সবাই চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশে চাকরির ক্ষেত্র হিসেবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিপ ইয়ার্ড, ডক ইয়ার্ড, ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি ইঞ্জিনিয়ার, এনডিটি ইত্যাদি সেক্টরেও এই বিভাগের গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি বা ব্যবসা করছে।

দেশের বাইরে চাকরির একটি বড় বাজার হলো সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর নেভাল আর্কিটেক্ট সেখানে চাকরি করছে। এ ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকায় মাস্টার্স বা পিএইচডির সুযোগও রয়েছে।

আয়রোজগার

সরকারি প্রতিষ্ঠানে একজন নেভাল আর্কিটেক্ট এন্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারের বেতন গ্রেড-৯ অনুযায়ী শুরুতে ২২/২৩ হাজার টাকা হয়ে থাকে। এ গ্রেডে সর্বোচ্চ বেতন ৫৩ হাজার টাকা। পদন্নোতির সাথে সাথে গ্রেড অনুযায়ী বেতন ও বৃদ্ধি পায়। বেসরকারি জাহাজ নির্মাণকারক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুরুতে বেতন কম হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানভেদে মাসিক ১৭-২৫ হাজার টাকা । তবে চাকুরির মেয়াদ বৃদ্ধির সাথে সাথে দক্ষতা অনুযায়ী বেতনও বৃদ্ধি পায়। এ পেশায় বেতন লাখ টাকার মতো হওয়া সম্ভব। তবে ডিজাইনিং ফার্মে কাজের সুযোগ পেলে ভালো অংকের অর্থ উপার্জন করা যায়। ডিজাইনিং ফার্ম গুলোতে সাধারণত চুক্তি অনুযায়ী কাজ পাওয়া যায়।

ক্যারিয়ার গ্রাফ

কর্মজীবনের শুরুতে একজন নেভাল আর্কিটেক্ট এন্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ার সহকারী প্রকৌশলি/আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করেন। দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র আর্কিটেক্ট/ইঞ্জিনিয়ার, সহকারী ম্যানেজার, সহকারী জেনারেল ম্যানেজার এবং ক্যারিয়ারের শীর্ষে প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার হওয়া সম্ভব। একজন অভিজ্ঞ নেভাল আর্কিটেক্ট এন্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ার দেশের বাইরেও অনেক কাজের সুযোগ পান। এক্ষেত্রে তাকে সৃজনশীল ও নিখুঁতভাবে কাজ করতে হবে।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *