খাদ্য প্রকৌশল নিয়ে ক্যারিয়ার

বর্তমান সময়ে শুধু নিজ দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশেও খাদ্য বিজ্ঞানের ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হচ্ছেকারণ বর্তমান সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণতাই খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে খাদ্য প্রকৌশলী বা ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের প্রয়োজনবিস্তারিত জানাচ্ছেন: শামস্ বিশ্বাস

খাদ্য প্রকৌশল নিয়ে ক্যারিয়ার

খাদ্য প্রকৌশল (Food Engineering) হলো প্রকৌশলবিদ্যার সেই শাখা, যেখানে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, গুণগত মান নির্ণয়, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণসংক্রান্ত তাত্ত্বিক ও বাস্তবধর্মী জ্ঞান অর্জন এবং প্রয়োগ করা হয়। বিশ্বজুড়ে ফুড ইঞ্জিনিয়াররা সবচেয়ে কম খরচে সর্বোচ্চ পরিমাণ মানসম্মত খাদ্য উৎপাদন এবং বাণিজ্যিকীকরণে নিরলস অবদান রেখে চলেছেন।

ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং কি

কোনও পেশাদার ফুড টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান বা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রধানত ম্যানুফ্যাকচারিং, প্রসেসিং, প্রিজ়ারভেশন, প্যাকেজিং এবং ক্যানিংয়ের কাজ করতে হয়। আরও যে বিশেষ কিছু বিষয়ে তাদের কাজ করতে হয়, সেগুলো হল, সঠিক কোয়ালিটির কাঁচামাল সরবরাহ হচ্ছে কি না, ফুড প্রসেসিং-এর প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে কাজ করছে কি না সে বিষয়ে লক্ষ রাখা, ফুড প্রসেসিং সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি বিষয়ে নজর রাখা, খাবারে যাতে কোনও রকম ভেজাল বা অবাঞ্ছিত বস্তু মিশে না যায় তা লক্ষ রাখা, খাবারের পুষ্টিগুণ সঠিকভাবে বজায় থাকছে কি না, তা লক্ষ রাখা ইত্যাদি।

এ ছাড়াও ফুড প্রসেসিংয়ের অন্তর্গত আরও যে ধরনের পদে কাজ করতে হয়, তা হল,

অর্গানিক কেমিস্ট : কাঁচামাল থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করা।

বায়োকেমিস্ট : খাবারের ফ্লেভার, টেক্সচার, স্টোরেজ এবং কোয়ালিটি বিষয়টি নজর রাখতে হয়।

অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি : ফুড প্রডাক্ট-এর কোয়ালিটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হয়।

হোম ইকনমিস্ট : এই পদে যিনি কাজ করবেন তাঁকে নিউট্রিশন এবং ডায়েটেটিক্স-এর বিষয়েও জানতে হয়, এবং খাবারের পুষ্টি এবং উপকারিতার দিকটাও দেখতে হয়।

 ইঞ্জিনিয়ার : ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির প্ল্যানিং, ডিজ়াইনিং, ইমপ্রুভিং, মেনটেন্যান্স এবং প্রসেসিং সিস্টেম তদারকির কাজ করার জন্য কেমিক্যাল, মেকানিকাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল, ইলেকট্রিক্যাল, সিভিল এবং এগ্রিকালচারল ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন হয়।

রিসার্চ সায়েন্টিস্ট : খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অর্থাত্‌, খাবারের উত্‌পাদন, গুণমান, স্বাদবৈশিষ্ট্য, পুষ্টিগত গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা এবং উন্নয়নের কাজ করেন এই ধরনের গবেষক এবং বিজ্ঞানীরা।

ম্যানেজার এবং অ্যাকাউনট্যান্ট : অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এবং ফিন্যান্সিয়াল কাজকর্ম এঁদেরকেই দেখাশোনা করতে হয়।

এই পেশায় কেন?

খাদ্য মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা। তাই খাদ্যের গুণগত মান ও পুষ্টিগুণ বজায় রেখে মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেয়াটাই হল এই পেশার মূল কথা। তাছাড়া মানুষের কাছে মানসম্পন্ন খাদ্য পৌঁছে দেয়া ছাড়াও এই পেশায় রয়েছে কাজের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের হাতছানি। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলেই সব পেশায় ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ফুড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় সহজেই আপনি আপনার ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন। কারণ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। আর এভাবেই বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। তাছাড়া আগামী ২ থেকে ৩ বছরে বাংলাদেশের ফুড প্রসেসিং সেক্টর বাড়বে ১০ শতাংশেরও বেশি। তাই বুঝতেই পারছেন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্যারিয়ার কতটুকু সম্ভাবনাময় আপনার কাছে।

পড়ার যোগ্যতা

সাধারণত গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষার্থীরা ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বা খাদ্য প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক করতে চাইলে অবশ্যই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে নিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্তির ক্ষেত্রে ফুড টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। এরপর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে কৃতকার্য প্রথম সারির ভর্তি-ইচ্ছুকেরা স্নাতক পড়ার সুযোগ পান।

কোথায় কোথায় ভর্তি হওয়া যায়

বাংলাদেশে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় ১৯৬৪ সালে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড রুরাল ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে ‘ফুড টেকনোলজি’ নামক মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করার মাধ্যমে। কালের পরিক্রমায়, একই বিভাগ ২০০২ সালে দেশের প্রথম ‘বিএসসি ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং’ স্নাতক প্রোগ্রামে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করে। এই ধারা আজ অবধি সগৌরবে চলমান। যুগের চাহিদায় একে একে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যান্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নামে দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিগ্রি প্রদান শুরু করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ফুড অ্যান্ড প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং), ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি), যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (অ্যাগ্রো প্রসেস অ্যান্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং) ইত্যাদি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি দিয়ে থাকে।

কী কী বিষয় পড়ানো হয়

ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংকে বলা হয় একটি ‘মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি’ প্রোগ্রাম; অর্থাৎ আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার প্রায় সব অঙ্গনেরই কিছু না কিছু পড়াশোনা এখানে জরুরি। উদাহরণস্বরূপ স্নাতকের বিভিন্ন বর্ষে একজন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীকে স্ট্রাকচারাল, ইলেকট্রিক্যাল, কম্পিউটার সায়েন্স, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি নানাবিধ কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। আর বিভাগীয় কোর্সের মধ্যে প্রধান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন, ফুড কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজি, প্রসেস ডিজাইন, ফুড সেফটি ম্যানেজমেন্ট, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ইত্যাদি। এ ছাড়া স্নাতক শেষ বর্ষে বাধ্যতামূলকভাবে একটি রিসার্চ প্রজেক্ট এবং একটি ইন্টার্নশিপ অথবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং সম্পন্ন করতে হয়।

কাজের ক্ষেত্র

‘খাদ্যনিরাপত্তা’ এবং ‘নিরাপদ খাদ্য’ একটি দেশের সুখ-সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠিস্বরূপ। আয়তন না বাড়লেও, প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত খাদ্য জোগানের পাশাপাশি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অপরিসীম। ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে প্রধান হলো খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মূল্যায়ন এবং সংরক্ষণে ভূমিকা রাখা। কাজেই একটি জনবহুল দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের অবস্থান অনস্বীকার্য। এমতাবস্থায় ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’-এর আলোকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশে ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের কাজের পরিধি আগের থেকে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দ্রুতগতিতে ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই পেশায় কাজের সুযোগ। ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর দেশের বড় বড় ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন এনজিও যেমন এফএও, এফডিএ, ডাব্লুএইচও, ইউএনডিপি ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার সুযোগ। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও রয়েছে এ পেশায় চাকরির সুযোগ।

পড়ার খরচ কেমন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যান্য ডিগ্রির মতোই নামমাত্র খরচে এ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন সম্ভব। আর স্বীকৃত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত আড়াই থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে স্নাতক পড়াশোনা সম্পন্ন করা যায়। যেখানে ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে অনেক সময় পড়াশোনার খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব।

উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা

বাংলাদেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি দেয়, তাদের অধিকাংশই স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রিও দিয়ে থাকে। এর মাঝে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনেরও সুযোগ রয়েছে। ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টি বাংলাদেশে তুলনামূলক নতুন হলেও বহির্বিশ্বে বহু আগে থেকেই ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বা সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যাপক শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু আছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস এবং বিশ্বের বহু দেশে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাবৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষার সুবিধা রয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট এসব সম্মানজনক স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্নাতক ফলাফল, ভাষা দক্ষতা, জিআরই স্কোর, গবেষণাপত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে স্কলারশিপ প্রাপ্তি বিবেচনা করা হয়।

সম্ভাব্য আয়

ফুড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পেশায় নতুন অবস্থায় শুরুতেই ২৫ হাজার বা তারও বেশি টাকা বেতন পেতে পারেন। তবে প্রতিষ্ঠানভেদে বেতন হতে পারে ৪০ হাজার টাকা বা তারও বেশি। পর্যায়ক্রমে চাকরিরত অবস্থায় বেতনের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। তাছাড়া বিদেশেও এ পেশায় রয়েছে আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *