মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি

ক্রেডিট মোবিলিয়ার স্ক্যান্ডাল (১৮৭২)

মার্কিন পুঁজিবাদিতের দুর্নীতির উদাহরণ বলা যায় ক্রেডিট মোবিলিয়ার স্ক্যান্ডাল। আঠারোশ সত্তরের দশকে ক্রেডিট মোবিলিয়ার ইউনিয়ন প্যাসিফিক রেলরোড নির্মাণের কাজ পায় এবং সেজন্য প্রেসিডেন্ট গ্রান্টের প্রশাসনকে চড়া ঘুষ দিতে হয় তাদের। এই ঘুষ গ্রহীতাদের মধ্যে ছিলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট, স্পিকার এবং কংগ্রেসের বাকি সদস্যরাও। রাষ্ট্রপতি ইউলিসিস এস. গ্রান্ট সরাসরি এই কাজে যুক্ত ছিলেন না। তবে দায় এড়াতে পারেননি তিনিও। ১৮৭২ সালে সবার সামনে উঠে আসে এই দূর্নীতির কথা।

এটন অ্যাফেয়ার

অ্যান্ড্রু জ্যাকসন তখন ক্ষমতার প্রথম দুই বছর পার করছিলেন। সেসময় তার সেক্রেটারি অব ওয়ার পদে কাজ করছিলেন জন হেনরি এটন। শুধু কর্মী হিসেবে নয়, ভালো বন্ধু হিসেবেও গণ্য করতেন জুয়াকসন এটনকে। এটনের স্ত্রী মার্গারেট পেগি ও’নেইল ছিলেন পুবে এটনের মালিকানাধীন একটি বোর্ডিংহাউজ মালিকের মেয়ে। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিলো কিন্তু ইটন এবং তার স্ত্রী পেগি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন; তথাকথিত পেটিকোট বিষয়ে, ওয়াশিংটনের সমাজের নারীরা ইটনদের সাথে মেলামেশা করতে অস্বীকার করেবসে। এর মধ্যে ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এবং কংগ্রেসের সদস্যদের স্ত্রীরা। তারা পেগিকে ইটনের সাথে তার বিয়ের পরিস্থিতির কারণে অবজ্ঞার চোখে দেখেন; তারা তার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পরপরই বিয়ে করেছিল, স্বাভাবিক শোকের সময়ের জন্য অপেক্ষা না করেই, গুজবের জন্ম দেয় যে সে তার মৃত্যুর আগে তার প্রথম স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত ছিল। মাঝখানে ফাঁস হয়ে যায় মার্গারেটের একাধিক শারীরিক সঙ্গীর কথা। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে জ্যাকসনের কেবিনেটেও।

সেসময় পুরো কেবিনেট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষ এটনকে সমর্থন করছিলো, আরেকপক্ষ বিরোধী। জ্যাকসন এটনকে সমর্থন করায় ধীরে ধীরে মানুষের মনে নেতিবাচক জায়গা করে নেন এবং ১৮৩১ সালে এটন-বিরোধী এক কেবিনেট সদস্যকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এই ঘটনার পর কেবিনেটের অনেকেই স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন। জ্যাকসনের পুরো ক্যাবিনেট ভেঙ্গে যায় এই একটি কারণে।

টিপট ডোম

ঘুষ খেয়ে বিনা দরপত্রে টিপট ডোম নামের এক কোম্পানিকে কাজ দেওয়া থেকেই এই কেলেঙ্কারির জন্ম। নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির আগে টিপট ডোম কেলেঙ্কারিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কুখ্যাত রাষ্ট্রীয় ‘স্ক্যান্ডাল’।

টিপট ডোম বলতে তখন ইয়োমিং-এ নেভির তেলের রিসার্ভগুলোকে বোঝানো হতো। দুর্নীতির বড় উদাহরণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন জি হার্ডিং-এর সেক্রেটারির একটি ঘটনা হৈচৈ ফেলে দেয়, তিনি গোপনে তেলের রিজার্ভ ইজারা দেওয়ার বদলে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার লিবার্টি বন্ড গ্রহণ করেন। এই কাজের জন্য তিনিই প্রথম কোন কেবিনেট সেক্রেটারি যাকে জেলে যেতে হয়।

এই ঘটনা ওই সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পুরো প্রশাসনের ভেতরটা পচে গেছে। এই ঘটনার সূত্র ধরেব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয় এবং দূর্নীতিসহ হার্ডিং-এর ব্যক্তিগত জীবনের নেতিবাচক ঘটনাও বেরিয়ে আসে। জানা যায়, তিনি একাধিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। এমনকি নান্না পপহাম ব্রিটন নামের এক নারী দাবিও করেছিলেন যে তাঁর মেয়ে এলিজাবেথের বাবা আসলে প্রেসিডেন্ট হার্ডিং। তখন সব পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হলেও ২০১৫ সালে এসে ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষেই এলিজাবেথের পিতা হার্ডিং। এমনকি তার পরিচারিকা ন্যান ব্রিটনের সাথে তার সম্পর্কের কথা প্রকাশিত হয়। ফলে মানসিক চাপে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অফিসেই মৃত্যুবরণ করেন হার্ডিং।

রাষ্ট্রপতি ওয়ারেন জি. হার্ডিং মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি অন্যতম জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর পরে অবশ্য জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক র‍্যাংকিং অনুসারে হার্ডিং প্রায়শই সবচেয়ে খারাপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

ওয়াটারগেট

১৯৭০-এর দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা অডিও টেপ দেশটির প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে কংগ্রেসের সদস্য- সবার জীবনকে নাড়িয়ে দেয়। সেই টেপে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে আরো অনেকের সাথে ওয়াশিংটনে অবস্থিত ওয়াটেরগেট কমপ্লেক্সের ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি অফিসে গোপনে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহের ঘটনাতে চাপা দেওয়া নিয়ে আলোচনা করতে শোনা যায়।

নির্বাচন প্রচারাভিযান চলাকালে ১৭ জুন, ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দল ও প্রশাসনের ৫ ব্যক্তি ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটার গেইট ভবনস্থ বিরোধী ডেমোক্র্যাট দলের সদর দফতরে আড়িপাতার যন্ত্র বসায় এবং তা প্রকাশ হয়ে পড়লে নিক্সনের প্রশাসন কেলেঙ্কারিটি ধামা-চাপা দেওয়ার চেষ্ঠা করে। টেপটি প্রকাশিত হওয়ার পরপর অভিশংসনের মুখে পড়েন নিক্সন। এ ঘটনার ফলে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কেলেঙ্কারির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের ঘটনাটি প্রথম এই ধরণের ঘটনা। নিক্সনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ফোর্ড ক্ষমা করায় তিনি রেহাই পার। তবে এ কেলেঙ্কারিতে হোয়াট হাউজের উকিল থেকে শুরু করে এটর্নি জেনারেল, চিফ অব স্টাফসহ নিক্সন প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ৪৩ জনের জেল হয়।

ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি গণমাধ্যমে ফাঁস করা সাংবাদিকের নাম কার্ল বার্নস্টেইন।

ইরান-কন্ট্রা অ্যাফেয়ার

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির পর এটাকেই বলা হয় মার্কিন রাষ্ট্রপতির জন্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেংকারির ঘটনা। তৎকালীন রিগান প্রশাসন ইসরাইলের মাধ্যমে ইরানকে গোপনে অস্ত্র বিক্রি করছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা এই অস্ত্র কন্ট্রা বিদ্রোহীরা ব্যবহার করছিলো নিকারাগুয়ার সোশ্যালিস্ট স্যানদিনিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে। এতে করে বেশ কয়েকটি আইন ভেঙ্গেছিল প্রশাসন। কোন দলকে অর্থসাহায্য দেওয়ার সে সর্বোচ্চ সীমা, সেটা ভাঙ্গা হয়েছিলো। ইরানের কাছে অস্ত্র না বেচা এবং জিম্মি মুক্ত করতে টাকা না প্রদানের পক্ষে ফেডারেল সরকারের যে আইন দুটোই অমান্য করা হয়েছিলো। এই পুরো চুক্তিটিই চলছিলো মার্কিন জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে। হিজবুল্লাহ ৭জন মার্কিনিকে ১৯৮৫ সালে অপহরণ করেছিলো। এ কেলেঙ্কারির কারণে কিছু উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা প্রশাসন থেকে বিদায় নেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র, রাজনৈতিক পরিচালক, সিআইএ প্রধান, হোয়াইট হাউস কমিউনিকেশন ডিরেক্টর, স্টাফ প্রধান, নিরাপত্তা উপদেষ্টাও ওই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান সিনেট কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রদত্ত রিপোর্টে বলা হয়, পদচ্যুত জাতীয় নিরাপত্তা সহকারী সব তৎপরতার নায়ক ছিলেন।

অবশ্য পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান স্বীকার করেন, ইরানে মার্কিন জিম্মিদের মুক্তির বিনিময় তিনি গোপনে এ চুক্তি অনুমোদন করেছিলেন। এটি যে ভুল ছিল তা তিনি নিজেই পরবর্তীতে স্বীকার করে নেন।

মনিকাগেট কেলেঙ্কারি

প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দারুণ বিপাকে পড়েছিলেন। মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও আলোচিত নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা এটি।

১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম প্রেসিডেন্ট ৪৯ বছর বয়ষ্ক ক্লিনটনের সঙ্গে ২২ বছর বয়সের তরুণী মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হয়।

প্রেসিডেন্টের সাথে হোয়াইট হাউসের কর্মচারী রসালো প্রেমকাহিনী জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার পর সবাই নড়েচড়ে বসেন। কারণ ওটাই ছিল ক্ষমতাসীন কোনো প্রেসিডেন্টের এ রকম নারী কেলেঙ্কারির প্রথম ঘটনা।

১৯৯৫ সালে ওয়াশিংটন ডিসির পেনসিলভানিয়া এভিনিউয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির দাপ্তরিক বাসভবন হোয়াইট হাউসে চাকরি পায় লুইস এবং ক্লার্ক কলেজ গ্র্যাজুয়েট সুন্দরী মনিকা লিউনস্কি। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন তখন সপরিবারে এই রাজকীয় প্রাসাদে বাস করতেন।  সুন্দরী মনিকার সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যেই সখ্য গড়ে ওঠে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গভীর প্রণয় চলাকালে মনিকা এবং ক্লিনটন নিয়মিত অভিসারে মিলিত হতেন। তাদের প্রেম এতটাই রসালো ছিল যে, তারা হোয়াইট হাউসেই নয় বার গোপন অভিসারে লিপ্ত হন। তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যে পাঁচবার এ রকম অভিসারের সময় ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন হোয়াইট হাউসেই ছিলেন। কিন্তু তাদের এ অভিসারের খবর আড়িপাতায় বিখ্যাত মার্কিন গুপ্তচররা তো দূরের কথা হিলারিও টের পায়নি।

তবে এই গোপন সম্পর্ক গোপন থাকে না! মনিকা তার বিশ্বস্ত বন্ধু ও সেই সময় মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরিরত সহকর্মী লিন্ডা ট্রিপেকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার গোপন অভিসারের কথা জানান। ট্রিপ মনিকাকে এ সংক্রান্ত প্রমাণ ধরে রাখতে নানা পরামর্শ দেন। এখানেই ভুলটা করে বসেন মনিকা।

১৯৯৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ড্রাজ রিপোর্ট ওয়েবসাইটে প্রথম এই স্ক্যান্ডালের সংবাদ প্রকাশ হয়। ৩ দিন পরে ২১ জানুয়ারি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে এই স্ক্যান্ডালের খবর প্রকাশ করে।

এ ঘটনা সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর সিনেট সদস্যরা প্রেসিডেন্টের নৈতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে ইমপিচমেন্টের দাবি করেন। ক্লিনটনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনেক সদস্য ও বিরোধী রিপাবলিকানরা এ দাবি সমর্থন করেন।

মিথ্যা কথা বলে শপথ-ভঙ্গ করা এবং বিচারে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে তাকে অভিশংসিত করা হয়েছিল। মনিকা লিউনস্কির সাথে যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে মিথ্যা বলেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, এবিষয়ে তিনি মনিকা লিউনস্কিকেও মিথ্যা বলতে বলেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল।

১৯৯৯ সালে যখন এসব অভিযোগে উচ্চ কক্ষ সিনেটে বিল ক্লিনটনের বিচার হয় তখন তাকে আর দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি। ২১ দিন ধরে তুমুল বিতর্কের পরেও এসব অভিযোগের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরের সমর্থন পাওয়া যায়নি। ভোটাভুটিতে ক্লিনটন জিতে সেই যাত্রায় ইমপিচমেন্টের হাত থেকে রক্ষা পান। ফলে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হয়নি। হিলারি ক্লিনটন পুরো ঘটনায় স্বামীর পাশে থেকে স্বামীর মনোবল জোগান। পুরো ঘটনাটি মার্কিন ইতিহাসে মনিকাগেট কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *