ব্যাটারি শিল্প
দিনদিন বাড়ছে দেশের ব্যাটারি বাজার। দেশের চাহিদা মেটাতে এই বাজারে প্রবেশ করেছে একাধিক শিল্পউদ্যোগ্তা। বর্তমানে সব ধরনের মোটরগাড়ি, মোটরসাইকেল, আইপিএস, সোলার প্যানেলসহ বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহারের জন্য ব্যাটারি উৎপাদন করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশে লিড অ্যাসিড ব্যাটারির বার্ষিক বাজার এখন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
স্বাধীনতার পর ব্যাটারি উৎপাদনে দেশে একটিমাত্র কারখানা ছিল। চার দশক পর ব্যাটিরি শিল্পখাত দেশের সমৃদ্ধ একটি শিল্প। তবে সম্ভাবনা থাকলেও সরকারের সুনজরের অভাবে এলোমেলোভাবে এই শিল্পটির বিকাশ হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এই শিল্পর উদ্যোক্তাদের মতে, নীতি-সহায়তা পেলে দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে এই খাত। রপ্তানির বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। সেটিকে কাজে লাগাতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এই শিল্পটি যেন পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য যথাযথ উদ্যোগও দরকার।
শুরুটা যেভাবে
১৯৫৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের লুকাস ব্যাটারি দেশে বাজারজাতকরণের কাজটি করত রহিমআফরোজ। সে সময় রাজধানীর নাখালপাড়ায় লুকাসের নিজস্ব কারাখানা ছিল। স্বাধীনতার পর লুকাস এ দেশ থেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। আর লুকাসের কারখানাসহ ব্যাটারির বাজারটি হাতবদল হয়ে রহিমআফরোজের কাছে চলে আসে। ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যাটারির বাজারে এককভাবে নেতৃত্ব দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০০০ সালের পর বড় আকারে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় হ্যামকো, নাভানা, র্যাংগস, পান্না গ্রুপের মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠান। রহিমআফরোজ ও হ্যামকোর পর বড় আকারে উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে ব্যাটারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় নাভানা। আবার ১৯৮০ সালের দিকে পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ছোট্ট পরিসরে ব্যাটারির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু করে পান্না ব্যাটারি লিমিটেড। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি ‘ভলভো’ ব্র্যান্ড নামে সম্পূর্ণ তৈরি ব্যাটারি বাজারজাত শুরু করে।
বর্তমান অবস্থা
দেশে ড্রাইসেল ও লিড অ্যাসিড—এই দুই ধরনের ব্যাটারি তৈরি হয়। পেনসিল ব্যাটারি হিসেবে বহুল পরিচিত পণ্যটিই ড্রাইসেল ব্যাটারি। তবে ড্রাইসেল ও লিড অ্যাসিড ব্যাটারি, দুটি আলাদা শিল্প। জানা গেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দুই ধরনের লিড অ্যাসিড ব্যাটারি তৈরি করে থাকে—অটোমেটিভ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিপ সাইকেল। এ ছাড়া মোবাইল ফোন টাওয়ারের জন্য ব্যবহৃত ভালভ রেগুলেটেড লিড অ্যাসিড (ভিআরএলএ) ব্যাটারির বড় বাজার আছে। এই ব্যাটারি তৈরিতে কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা থাকলেও এখনো বাজারের বড় অংশ দখল করে আছে আমদানিকৃত ব্যাটারি। কারণ, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো বিদেশি ব্যাটারিই সংগ্রহ করে থাকে।
বাংলাদেশ অ্যাকিউমুলেটর অ্যান্ড ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিএমএ) তথ্যানুযায়ী, দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বছরে ১৮ লাখের বেশি ব্যাটারি প্রস্তুত হয়। এর মধ্যে গাড়ি ও মোটরসাইকেলে ব্যবহৃত অটোমেটিভ ব্যাটারি পাঁচ লাখ ৯০ হাজার, আইপিএস ও ইউপিএসের ব্যাটারি চার লাখ ৩৭ হাজার, জেনারেটর ও ভারী যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাটারি এক লাখ এবং সোলার প্যানেলের ব্যাটারি সাত লাখ। এ ছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতকৃত অটোমেটিক ব্যাটারি বিশ্বের ৫৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ পিস ব্যাটারি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে যার প্রায় পুরোটাই করছে রহিমআফরোজ। প্রতিবছর ব্যাটারির চাহিদা বাড়ছে অটোমেটিভে ১০ শতাংশ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিপ সাইকেলে ১৫ শতাংশ হারে।
বিএবিএমএর হিসাব অনুযায়ী, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে প্রায় ২০টি ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সমিতির সদস্য ১২। এ খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রহিমআফরোজ। গ্লোবাট, লুকাস ও স্পার্ক ব্র্যান্ড নামে ব্যাটারি বাজারজাত করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া হ্যামকো, নাভানা ব্যাটারি, র্যাংগস, পান্না গ্রুপ, রিমসো ব্যাটারি অ্যান্ড কোম্পানি বর্তমানে লিড অ্যাসিড ব্যাটারির বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জানা গেছে, বিভিন্ন ধরনের লিড অ্যাসিড ব্যাটারি তৈরির কাঁচামালের ৫০ শতাংশই কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন থেকে আমদানি করতে হয়। তবে বাকি কাঁচামাল দেশেই পুনরুৎপাদনের (রিসাইক্লিং) মাধ্যমে পাওয়া যায়। বর্তমানে এ খাতে প্রায় ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা
দেশে তৈরি ব্যাটারি অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে সক্ষম হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে কিছু আমদানিকারক আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে (চাহিদাপত্রে পণ্যের দাম কম দেখানো) পণ্যটি আমদানি করছে। সাধারণত কোনো পণ্যে শুল্কহার বেশি হলে চালানপত্রে এর দাম কম দেখানো হয়। এতে শুল্কও পরিশোধ করতে হয় কম। অধিক পরিমাণ শুল্ক পরিশোধ এড়ানোর এ কৌশলই হচ্ছে আন্ডার ইনভয়েসিং। চীন ও কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকৃত এসব ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল ব্যাটারি বৈধপথে আসলেও প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য দেখিয়ে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। ফলে এসব ব্যাটারি দেশীয় ব্যাটারির চেয়ে কম মূল্যে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বিএবিএমএ জানিয়েছে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ইজিবাইকে ব্যবহার উপযোগী ব্যাটারি সাড়ে নয় থেকে দশ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু সঠিক শুল্ক দিয়ে বৈধভাবে আমদানি করা হলে এই ব্যাটারির দাম কোনভাবেই ১৪-১৫ হাজারের নিচে হওয়ার কথা নয়। কারণ এর সঠিক দাম ৯০ ডলার বা ৭ হাজার ২শ’ টাকার মতো। এর সাথে শতকরা ৯২ ভাগ কর যুক্ত হলে কেনা দাম পড়বে ১৩ হাজার ৮শ’ টাকার মতো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের বাইরে প্রতিটি ব্যাটারি ৯০ ডলার হলেও আন্ডার ইনভয়েসিং করে ৩৮-৪৫ ডলার দেখানো হচ্ছে। তাই শুল্কায়নের ক্ষেত্রেও ৫০ শতাংশ ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। এতে দেশ রাজস্ব হারাচ্ছে, দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও মার খাচ্ছে।
এই শিল্পের উদ্যোক্তদের মতে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন বা ডব্লিওটিও’র নীতিমালা অনুযায়ী, আমদানি নিষিদ্ধ করা না গেলেও স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় ব্যাটারি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। আমদানিকারকরা মূল্য কম দেখিয়ে নিয়মিত শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন। তাই আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করতে ফিক্সড ট্যাক্সেশন আরোপ করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় চার লাখ ব্যাটারি আমদানি হচ্ছে। প্রায় অর্ধেক মূল্যে শুল্কায়ন করায় বছরে ১০০-১২০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দেয়া হচ্ছে।
পদক্ষেপ
ব্যক্তি খাতের একক প্রচেষ্টায় ব্যাটারির বাজার বড় হয়ে উঠেছে। তাই এটিকে এখন শিল্প বিবেচনায় নিয়ে শিল্পসম্মত বিকাশে সরকারি সহায়তা দরকার। পাশাপাশি পরিবেশদূষণ রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
ব্যাটারি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে অ্যাসিডের ব্যবহার হয়। আবার উৎপাদন পর্যায় ও ব্যবহারের পর ব্যাটারি যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের জন্য তা হুমকিও তৈরি করছে। দেশে যে পরিমাণ ব্যাটারি ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়, তার ৫০ শতাংশ পুনঃ ব্যবহারযোগ্য বা রিসাইক্লিং করা যেতে পারে। তাই পরিবেশের ক্ষতি এড়াতে এ ক্ষেত্রে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, ব্যাটারি আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধে এনবিআরের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বন্ধ হয়নি। তবে ভবিষ্যতে যাতে কেউ শুল্ক ফাঁকি দিতে না পারেন, সেজন্য আরো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply