অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

বিশ্বজুড়েই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে দিনদিন বাড়ছে উড়োজাহাজ বা বিমানের চাহিদা ও ব্যবহার। এসব বিমান তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন পড়ে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (Aeronautical Engineering) বা উড়োজাহাজ প্রকৌশলীদের। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাইলট বা বৈমানিকের কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম চ্যালেঞ্জিং নয়। উপরন্তু পাইলটের চেয়ে বেশি আয়ের সুযোগ রয়েছে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের। এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার সঙ্গে সামাজিক মর্যাদা, খ্যাতিও বেড়েছে কয়েক গুণ। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস্ বিশ্বাস

অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইলে

যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো গতিশীল ও নিরাপদ করতে বিশ্বজুড়েই বাড়ছে উড়োজাহাজের ব্যবহার। এ শাখার ক্রমবর্ধমান চাহিদা জোগানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যোগ্য ইঞ্জিনিয়ার তৈরি। বর্তমান বিশ্বে যার প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার সঙ্গে বর্তমানে সামাজিক মর্যাদা ও খ্যাতিও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। উল্লেখ্য, যে উড়োজাহাজ তৈরি থেকে শুরু করে এর রক্ষণাবেক্ষণ, ওভারহোলিং এবং বিভিন্ন এয়ারলাইনস মেইনটেন্যান্স সংস্থায় দেশে-বিদেশে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের অফুরন্ত কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব
অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা অ্যারোপ্লেন, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এয়ারশিপসহ সব ধরনের মনুষ্যবাহী ও মনুষ্যবিহীন উড়োজাহাজ এবং সম্পর্কিত সিস্টেমের ডিজাইন, বিকাশ, নির্মাণ ও পরীক্ষা করে। কমিউনিকেশন, ইনস্ট্রুমেন্টেশন, নেভিগেশন, প্রপালশন সিস্টেম, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও রোবোটিকসহ অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেশকিছু বিশেষ দিক রয়েছে। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো প্রকৌশলের একটি শাখা, যা বিমান ও মহাকাশযানের নকশা, রক্ষণাবেক্ষণ, মানোন্নয়ন, উৎপাদন ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে। বিমানের কর্মক্ষমতা ও নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য অ্যারোডাইনামিকস, প্রপালশন, স্ট্রাকচার, অ্যাভিওনিকস এবং উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

পড়ার যোগ্যতা
অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইলে একজন শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমানের গ্রেড পদ্ধতিতে ৫.০০ স্কেলে সর্বমোট জিপিএ ৯.০০সহ উপরোক্ত পরীক্ষাগুলোর প্রতিটিতে গ্রেড পদ্ধতিতে ৫.০০ স্কেলে সর্বনিম্ন জিপিএ ৪.৫০ প্রাপ্ত হতে হবে। এছাড়া এইচএসসিতে ইংরেজি, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও রসায়নে মোট জিপিএ ১৭-এর ওপর থাকতে হবে। অতঃপর নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে এবং মেধাতালিকায় স্থান থাকা সাপেক্ষে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন।

পড়াশোনার সুযোগ
বর্তমানে বাংলাদেশে শুধু দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) দেশের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম চালু করে। পাশাপাশি ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিভাগ চালু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএএইউ) বাংলাদেশের একমাত্র বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে এ বিষয়ে পড়াশোনা করা যায়। উভয় বিশ্ববিদ্যালয় চার বছরমেয়াদি বিএসসি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা ও বিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে আসছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের জন্য চার বছরে আনুমানিক ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। এছাড়া মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের জন্য আনুমানিক সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়।
বিএসসি (অ্যারোনটিক্যাল) ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে দেশের দুই/একটি কলেজ থেকে এ বিষয়ে বিএসসি এবং ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করা যায়।

উচ্চশিক্ষা
অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা দেশে ও বিদেশে অন্য যেকোনো ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার মতোই বিদ্যমান। বিএসএমআরএএইউ ও এমআইএসটিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের সব প্রান্তে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ রয়েছে।

কী পড়ানো হয়
বিএসএমআরএএইউ অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টি মূলত দুইভাবে বিভক্ত একটি অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যটি অ্যাভিওনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং। অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছে উড়োজাহাজের স্ট্রাকচার ও ডিজাইন, মেকানিকস, ফ্লুইড মেকানিকস, নিউমারিক্যাল অ্যানালাইসিস, মেকানিকস অব ম্যাটেরিয়ালস, হিট ট্রান্সফার, এয়ারক্রাফট লোডিং অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস, হাই স্পিড অ্যারোডিনামিকস, কমপ্রেসেবল ফ্লুইড ডায়নামিকস, মেশিন ডিজাইন, স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যারোস্পেস ম্যাটেরিয়ালস ইত্যাদি।
আর অ্যাভিওনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মূল বিষয়গুলো হচ্ছে এয়ারক্রাফট কন্ট্রোল অ্যান্ড নেভিগেশন এবং এভিয়েশন ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট অ্যানালাইসিস, এয়ারক্রাফট ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমস, এয়ারক্রাফট অ্যাভিওনিকস সিস্টেমস, রাডার ইঞ্জিনিয়ারিং, কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি।

কাজের সুযোগ
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলোয় চাকরি নিতে পারবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এয়ারলাইনস এবং এভিয়েশন কোম্পানি যেমন বিমান বাংলাদেশ, ইউএস-বাংলা, এয়ার অ্যাস্ট্রা, নভোএয়ার ইত্যাদিসহ অন্যান্য এয়ারলাইনস; বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড; বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) কাজেও অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের ভালো চাহিদা রয়েছে। এছাড়া দেশের বাইরের এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলোয়ও তারা চাকরি করতে পারবেন। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা হচ্ছেন বিশ্বের সব চেয়ে বেশি পারিশ্রমিকপ্রপ্ত ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়া দেশে বিসিএস, সশস্ত্র বাহিনী, সিভিল এভিয়েশন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পাওয়ার প্ল্যান্ট, ব্যাংক ইত্যাদিতেও ওই শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ রয়েছে। দেশের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠান, যেমন নাসা, ইন্টেল, বোয়িং, এয়ারবাস, লকহিড মার্টিন ইত্যাদি কোম্পানিসহ অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট পদেও চাকরির সুযোগ রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী উড়োজাহাজ পরিচালনার পাশাপাশি ইউএভি, স্পেস রিসার্চ, ড্রোন ও স্যাটেলাইটের ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়ছে। ফলে এ সেক্টরে দিন দিন চাকরির বাজার প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে এভিয়েশন সেক্টরে দক্ষ জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এভিয়েশনে ও স্পেসবিষয়ক অগ্রগতির জন্য অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। এ পেশার দক্ষ জনবল বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং টেকসই উড়োজাহাজ পরিবহনের বিকাশকে সক্ষম করে জাতীয় প্রতিরক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বৈশ্বিক সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে যোগাযোগ খাত ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমানে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা দক্ষতার সঙ্গে তাদের জায়গা করে নিচ্ছেন।

আয়রোজগার
একজন উড়োজাহাজ প্রকৌশলী যেকোনো এয়ারলাইনস কোম্পানিতে চাকরির শুরুতেই ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতন পেতে পারেন।  দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে এদের বেতন আরও বাড়ে। এছাড়া চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর অন্যান্য সুবিধা যেমন বোনাস, ওভারটাইম, খাবার, চিকিৎসা খরচসহ আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *