‘মহামানুষ’ হাজী মুহম্মদ মুহসীন

ভোগ নয়, ত্যাগেই মধ্যে মিলে মহৎ জীবন। এই কথার সব চেয়ে বড় উদাহরণ হাজী মুহম্মদ মুহসীন। বোনের মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারী হিসাবে বিশাল সম্পদের মালিক হন তিনি। কিন্তু তিনি সেই সম্পদ নিজে ভোগ না করে মানুষ এবং মানবতার কল্যাণে ব্যয় করেন।

ব্রিটিশ সরকারের নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (ইংরেজি ১৭৭০ সালে) সময় তাঁর দানের ওপর নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্নাভাবজনিত মৃত্যু খেকে বেঁচে গিয়েছিল। ওই সময়ের মহাদুর্ভিক্ষে তিনি বহু লঙ্গরখানা স্থাপন করেছিলেন এবং সরকারি সাহায্য তহবিলে অর্থ প্রদান করেছিলেন।

মহসিন ট্রাস্টের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের হুগলী মহসিন কলেজ। এইটিই ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার কলেজ যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যে-কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। এই কলেজের ছাত্র ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র টট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

হাজি মোহাম্মদ মহসীনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অধিকাংশ জমি ছিল যশোর ও খুলনায়। এই ট্রাস্ট এস্টেটের জমিতে অনেকগুলো দাতব্য হাসপাতাল, সরকারি অফিস, খুলনা-কলকাতা রেললাইন ছাড়াও গড়ে ওঠে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খুলনার দৌলতপুরের সরকারি ব্রজলাল কলেজের ৪২ একর জমির ৪০ একরই মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের জমি। ব্রজলাল কলেজের অনেক আগে তৈরি হয় দৌলতপুর মহসিন হাই ইংলিশ স্কুল। মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অর্থে খুলনার দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় মহসিন বালিকা বিদ্যালয় ও মহসিন মহিলা কলেজ।

মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ডের অর্থে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার মাদ্রাসাটি এখন সরকারি কবি নজরুল কলেজ ও চট্টগ্রামের মাদ্রাসাটি এখন হাজি মহম্মদ মহসিন কলেজ। আর রাজশাহীরটি এখন হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।

মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ডের অর্থে যশোর, রংপুর, পাবনা, ফরিদপুর, বাকরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নোয়াখালি ও সিলেট জেলার স্কুলগুলোতে মুসলিম ছাত্রদের দুই তৃতীয়াংশ বেতন ও একজন আরবি শিক্ষকের বেতন দেয়া হত।

চিরকুমার হাজী মুহম্মদ মুহসীন সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত ইমামবাড়া প্রাসাদে বাস করতেন না। ইমাম বাড়ির পাশে একটি ছোট কুটিরে বাস করতেন। আর কোরআন শরীফ নকল করে যা পেতেন তা দিয়েই চলতেন। নিজ হাতে রান্না করে অধীনস্থদের নিয়ে বসে খেতেন।

মৃত্যুর ২০০ বছর পরও এতটুকু ম্লান হয়নি তাঁর স্মৃতি, কীর্তিগাথা। আজও তিনি দানবীর হিসেবে অমর, প্রাতঃস্মরণীয়। ত্যাগের মহিমায় তিনি ‘‘মহামানুষ মুহসীন’।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *