বেসরকারি স্কুল শিক্ষক

শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তাকেই শিক্ষক বলা হয়। বাংলাদেশ শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বেসরকারি খাতে স্কুল গড়ে উঠেছে। উচ্চশিক্ষা শেষে বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা আকর্ষণীয় একটি পেশা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস্ বিশ্বাস।

বেসরকারি স্কুল শিক্ষক

প্রাচীন কাল থেকে আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক পেশা হারিয়ে গেছে, অনেক পেশার উত্থান ঘটেছে, কিন্তু শিক্ষকতা টিকে আছে তার সম্মানের জায়গায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিতদেরই শিক্ষক বলা হয়। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতার কাজে যারা আছেন তাদেরকে শিক্ষক বলা হয় আর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধ্যাপক বলা হয়ে থাকে। শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়। কেননা একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন তার অনুসারীদের জ্ঞান ও ন্যায় দীক্ষা দিতে। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধ কে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদান কে সার্থকই করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেন। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি স্কুল গড়ে উঠেছে।

কাজের সুযোগ

বাংলাদেশের অগ্রগতির সাথে সাথে বাড়ছে শিক্ষার চাহিদা। সকল শ্রেণী পেশার অভিভাবকরা চায় তার সন্তান যেন শিক্ষিত হয়ে জীবনে সামনের দিকে এগিয়ে যাক। শহরের সাথে সাথে এখন গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে মানসম্মত ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের স্কুল। প্রয়োজনের চাহিদায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্বলিত শহরগুলোতে গড়ে উঠছে অসংখ্য কে জি স্কুল, প্রি-স্কুল, জুনিয়র স্কুল এবং হাই স্কুল।

শিক্ষা স্তরের প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। বর্তমানে আমাদের দেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। অবশ্য প্রাথমিকের আগে রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। প্রথম শ্রেণীর আগেই এখানে রয়েছে দুটি শ্রেণী- নার্সারি ও কেজি। আর প্রাথমিক স্তর ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী। প্রাথমিকের পরবর্তী স্তর মাধ্যমিক। মাধ্যমিক স্তর ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। এ স্তরকেও কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়- সাধারণ শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা এবং ভোকেশনাল শিক্ষা।

দেশে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২,৭২৫টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৪,৩২২টি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৬,১০৯টি। এর সাথে রয়েছে ৭৫৯৮টি বেসরকারি মাদরাসা। এর সাথে সাথে রয়েছে, বস্তিবাসী এবং নিম্নবিত্তদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের জন্য ব্র্যাক, আশা, প্রশিকা, জাগো ফাউন্ডেশনসহ একাধিক এনজিও কাজ করে যাচ্ছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি, এনজিও, দাতা সংস্থা বা কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ গড়ে উঠা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ অনেক বেশি। বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক অথবা জুনিয়র টিচার হিসেবে যে কোন ধরনের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের বিভিন্ন ধরনের স্কুল যেমন প্রি-স্কুল, কে জি স্কুল, জুনিয়র স্কুল, সিনিয়র স্কুল বা হাই স্কুলে কাজের সুযোগ থাকে।

দায়িত্ব

  • একজন বেসরকারি স্কুল শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব তার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়া। জ্ঞান অর্জনে সহায়তা কর।
  • আদর্শ ছাত্র হওয়ার জন্য দিকনির্দেশনা দেয়া। তাদের আগামীর জন্য তৈরি করা।
  • পাঠ্যক্রম অনুযায়ী যথাযথ শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার ও পাঠ পরিকল্পনা করে অংশগ্রহণ মূলক ক্লাস নেয়া। পুরো ক্লাস বা ছোট গ্রুপে শিক্ষার্থীদের পড়ান। কোন শিক্ষার্থী ক্লাসে পাড়া না বুঝলে, ক্লাসের পর বিশেষভাবে তাকে পড়া বুঝিয়ে দেয়া।
  • এক জন শিক্ষককে পেশাদারী এবং নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সব সময় সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়।
  • শিক্ষার্থীদের ক্ষমতা, শক্তি এবং দুর্বলতাগুলি মূল্যায়ন করে তাদের সেভাবে দিকনির্দেশনা দেয়া।
  • শিক্ষার্থীর প্রতি একজন শিক্ষকের আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় হবে ইতিবাচক হতে হবে। শিক্ষক নেতিবাচকতা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ গঠনে সাহায্য করে এবং গণতান্ত্রিক মনোভাব গড়ে তুলে।
  • ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে সচেতন করে তুলে।
  • নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, ব্যক্তিত্ব, মেধা যোগ্যতা, মননশীলতা আর আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করা।
  • শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন করবেন এবং দিবসের তাৎপর্য সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলা।
  • পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান দেয়া।
  • শ্রেণিতে শিক্ষাদানের পাশাপাশি শ্রেণির বাইরে বিভিন্ন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সাথে থাকা।
  • শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি সম্পর্কে অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করা।
  • অন্যান্য দপ্তরিক দায়িত্ব যেমন: শিক্ষার্থী উপস্থিতির তালিকা তৈরি করা, পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করা, পরীক্ষা নেয়া এবং রেজাল্ট তৈরি করা।

যোগ্যতা

স্কুলে শিক্ষকতার জন্য অবশ্যই স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। সাধারণত যে বিষয়ের শিক্ষক প্রয়োজন সে বিষয়েই উচ্চতর ডিগ্রি চাওয়া হয়। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে শিক্ষকতার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা বাঞ্ছনীয়। মানসম্মত ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে শিক্ষকতা করতে চাইলে অনার্স/মাস্টার্সে ভালো ফলাফল থাকতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ব্যাচেলর অফ এডুকেশন (বিএড)/ মাস্টার্স অফ এডুকেশন (এমএড) ডিগ্রিধারীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর সাথে সাথে প্রয়োজন হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় কৃতকার্যের সনদ।

দক্ষতা ও জ্ঞান

  • শিক্ষার্থীদের ভালো ছাত্র এবং মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রতি আগ্রহী এবং দায়িত্বশীল হতে হবে।
  • শিক্ষকদের জন্য মূল দক্ষতা হল: উদ্যম, চিন্তা, প্রতিশ্রুতি, শক্তি এবং শৃঙ্খলা।
  • যে বিষয়টিতে শ্রেণিতে পাঠদান করবেন সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। পাঠ্যক্রম নখদর্পণে থাকতে হবে।
  • শিক্ষার্থী, অন্যান্য শিক্ষক, ম্যানেজমেন্ট এবং অভিভাবকের সাথে কাজ করার জন্য দুর্দান্ত যোগাযোগ দক্ষতা।
  • ভাল শ্রোতা হওয়া।
  • দ্রুত শিখার সক্ষমতা।
  • শক্তিশালী সাংগঠনিক দক্ষতা।
  • শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেয়ার ক্ষমতা।
  • যত্নশীল হতে শিক্ষার্থীদের প্রতি।
  • স্বতন্ত্র এবং দলগতভাবে কাজ করার ক্ষমতা।
  • শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন এবং অনুভূতি একটি বোঝার ক্ষমতা। শিক্ষার্থীর আচরণ দেখে তার মনের ভাষা বুঝতে হবে শিক্ষককে।
  • শ্রেণির পাঠ আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হতে হবে। পাঠ্য বইয়ের জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ ও ব্যবহারিকে দক্ষতা থাকতে হবে।
  • শিক্ষককে অবশ্যই সময়ানুবর্তী হতে হবে।
  • একজন শিক্ষকের অন্যতম গুণ ধৈর্যশীলতা।
  • থাকতে হবে সৃজনশীলতা।
  • ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষকতা করতে চাইলে অবশ্যই ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে।

আয়রোজগার

বেসরকারি স্কুল শিক্ষকের বেতন অনেকাংশে নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের আকার, মান এবং স্থানের উপর। ঢাকা কিংবা বড় শহরে মানসম্মত বাংলা কিংবা ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলে কোন রকম অভিজ্ঞতা না থাকলে বেতন সাধারণত ১৮-৩০ হাজার টাকা হয়ে থাকে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান স্বনামধন্য হওয়াতে দক্ষ হলে বেতন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সাধারণত ৫ থেকে ৬ বছরেই বেতন দ্বিগুণ হয়ে যায়। ছোট শহরের বড় কিংবা বড় শহরের মাঝারি বা ছোট স্কুলে বেতন সাধারণত কম হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানভেদে শুরুতে বেতন ৭-১৫ হাজার টাকা হয়ে থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ক্লাস বা দায়িত্বের জন্য অতিরিক্ত টাকা পাওয়া যায়।

ক্যারিয়ার গ্রাফ

সাধারণত শিক্ষকতার ক্যারিয়ার হয় জুনিয়র টিচার বা সহকারি শিক্ষক হিসেবে। এর পরে একমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেই একজন সিনিয়র শিক্ষক হতে পারেন। অনেক সময় কর্মজীবনের শুরুতে ছোট-মাঝারি মানের স্কুলে শিক্ষকতা করে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হলে পরবর্তিতে বড় মাপের মানসম্মত স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পাওয়া যায়। শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হলে স্কুলের কোন কমিটির প্রধান, সহকারি প্রধান শিক্ষক, এমনকি ক্যারিয়ারের শীর্ষে প্রধান শিক্ষক হওয়া যায়।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *