বিশ্বজুড়ে জলদস্যু আতঙ্ক

গত ১২ মার্চ ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশের পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। লম্ব সময়ের পরে আবারো বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনামে জলদস্যুদের আতঙ্ক। শুধু সোমালিয়ায় নয় বিশ্বের বহু এলাকায় সামুদ্রিক জলদস্যুদের আতঙ্ক ও হুমকি ক্রমশ বাড়ছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন: শামস্ বিশ্বাস

বিশ্বজুড়ে জলদস্যু আতঙ্ক

ভারত মহাসাগরের আফ্রিকা উপকূলে এক দশক আগে বড় আতঙ্ক হয়ে ছিল সোমালি জলদস্যুরা। একের পর এক বাণিজ্যিক জাহাজে তারা হানা দিচ্ছিল, নাবিকদের জিম্মি করে আদায় করছিল মুক্তিপণ।

আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নানা তৎপরতায় গত কয়েক বছর জলদস্যুদের উৎপাত কমে এলেও এখন আবার বাড়ছে। গত তিন মাসে সোমালিয়া উপকূলে জাহাজ ছিনতাই গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউট (আরইউএসআই)।

মাস খানেকের মধ্যৌ অন্তত দুটি জাহাজ ছিনতাই হওয়ার পর সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছে এবার বাংলাদেশের একটি জাহাজ। গত ১২ মার্চ ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশের পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। শুধু সোমালিয়ায় নয় বিশ্বের বহু এলাকায় সামুদ্রিক জলদস্যুদের আতঙ্ক ও হুমকি ক্রমশ বাড়ছে। জলদস্যুদের প্রভাবিত এলাকার তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো:

সোমালিয়া

ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক দেশ। আফ্রিকার সোমালিয়া। শান্তি ও সমৃদ্ধিতে আফ্রিকার সুইজারল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল সোমালিয়া। কিন্তু আজ সেই দেশ এক বিভীষিকার নাম। সোমালিয়ার নাম শুনলেই সবার চোখে ভাসে যুদ্ধ বিগ্রহ আর জলদস্যুদের কথা।

সোমালিয়ার জলদস্যুতা মূলত উপকূলে অবৈধভাবে মাছ ধরার ফলেই সৃষ্টি হয়েছিলো। বিদেশি জাহাজ থেকে এই উপকূলের পানির মধ্যে বিষাক্ত বর্জ্য ডাম্পিং করায় স্থানীয়দের পরিবেশ বসবাসের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। এর প্রতিবাদে সশস্ত্র দলে বিভক্ত হয়ে বিদেশি জাহাজ এ অঞ্চলে প্রবেশ বন্ধ করার চেষ্টা করে স্থানীয় জেলেরা। তবে ১৯৯৫ সালে একদিন আচমকাই একটি জাহাজের দখল নেয় জেলেরা। তাদের ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ নেয়ার একটি ঘটনাই বদলে দিল সাধারণ জেলেদের। তাড়িয়ে দেয়ার চেয়ে জব্দ করে ক্ষতিপূরণ কিংবা মুক্তিপণ আদায় করা যে বেশ সহজ, সেটিও পছন্দ হয়  উপকূলের জেলেদের।

মাছ ধরার বদলে একে একে আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম হাতে তুলে নেয় তারা। ছোট ছোট নৌকাগুলোর সঙ্গে ইঞ্জিন জুড়ে বদলে দেয়া হয় শক্তিশালী আক্রমণকারী রণতরীতে। অর্থের লোভে তাদের সাথে যুক্ত হয় সাবেক সেনাসদস্য এবং প্রযুক্তিবিদরা। যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান থাকায় সেনাসদস্যদের জায়গা হয় আক্রমণের অগ্রভাগে। আর, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বাণিজ্যিক জাহাজের রাডার ফাঁকি দিতে সাহায্য করে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের দল।

জলদস্যুতার বীমা পলিসিতে উচ্চহারের প্রিমিয়াম ছাড়াও নানা সমস্যা আছে। সোমালিয়ায় সামুদ্রিক জলদস্যুতা বিশ্বমহলের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।

ভারত মহাসাগর

১৯৯০-এর দশকের গোঁড়ার দিকে সোমালি গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত মহাসাগরে জলদস্যুতা আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় জাহাজের পাশাপাশি অন্য দেশের জাহাজও তাদের হামলার শিকার হয়। ভারত মহাসাগর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া অন্যতম সামুদ্রিক পথ হওয়ায় এখানে জলদস্যুতার প্রভাব মারাত্মক। জলদস্যুতার কারণে আন্তর্জাতিক পণ্যপরিবহনে বাধা তৈরি হয় এবং শিপিং ব্যয় বৃদ্ধি পায়, ওশেনস বিয়ন্ড পাইরেসি (ওবিপি) অনুসারে বিশ্ব বাণিজ্যে বছরে আনুমানিক ৬.৬ মার্কিন ডলার থেকে ৬.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ (ডিআইডব্লিউ) এর মতে, জলদস্যুতার চারপাশে মুনাফাখোরদের একটি সত্যিকারের শিল্পও গড়ে উঠেছে। বীমা কোম্পানি উল্লেখযোগ্য ভাবে জলদস্যু আক্রমণ থেকে তাদের মুনাফা বৃদ্ধি করেছে কারণ বীমা কোম্পানিগুলি প্রতিক্রিয়া হিসাবে হার প্রিমিয়াম বৃদ্ধি করেছে।

বহুজাতিক কোয়ালিশন টাস্ক ফোর্স কম্বাইন্ড টাস্ক ফোর্স ১৫০, এডেন উপসাগর এবং গার্ডাফুই চ্যানেলের মধ্যে একটি মেরিটাইম সিকিউরিটি পেট্রোল এরিয়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জলদস্যুতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভূমিকা গ্রহণ করে। সেপ্টেম্বর ২০১২ নাগাদ, ভারত মহাসাগরে জলদস্যুতার অনেকটা হ্রাস পায়। জলদস্যু কার্যকলাপে এই হ্রাসের কারণ জাহাজের মালিক এবং ক্রুদের সর্বোত্তম নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা অনুশীলন, বোর্ড জাহাজে সশস্ত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, এবং উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনীর আধুনিকায়ন ও উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি।

এডেন উপসাগর

ভৌগোলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ এডেন উপসাগর। লোহিতসাগরে ঢোকার মুখে অবস্থিত এই উপসাগর। এই পথ দিয়ে সুয়েজখালের দিকে যাওয়া মালবাহী জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু এর কাছেই এর কাছেই সোমালিয়া অবস্থিত। ফলে এই বাণিজ্যপথে সোমালি জলদস্যুদের তাণ্ডব চলে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বড় চিন্তার কারণ এই সমুদ্রপথের নিরাপত্তা।

ক্যারিবিয়ান

ভেনিজুয়েলার সংকটের কারণে, ২০১০-এর দশকে ক্যারিবিয়ানে জলদস্যুতা ফিরে আসে। একই রকম আর্থ-সামাজিক কারণে সোমালিয়ার উপকূলে মত এই অঞ্চলেও জলদস্যুতা বৃদ্ধি পায়। ২০১৬ সালে, প্রাক্তন জেলেরা জলদস্যুতে পরিণত হতে শুরু করে। ২০১৮ সাল নাগাদ ভেনেজুয়েলানরা আরো মরিয়া হয়ে উঠলে আতঙ্ক দেখা দেয় যে, ভেনেজুয়েলার জলদস্যুরা ক্যারিবিয়ান জলসীমা জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।

গিনি উপসাগর

উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা আর দক্ষিণের অ্যাঙ্গোলার কাছে গিনি উপসাগরও জলদস্যুরা হানা দেয়। ইউরোপীয় দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের তেলের জাহাজগুলো এই পথ দিয়েই চলাচল করে। ওত পেতে থেকে জলদস্যুরা এসব জাহাজে হামলা করে। এখানে অজানা অনেক আক্রমণের ঘটনা ঘটে। একযুগ আগে ২০১২ সালে, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো, ওসেনস বিয়ন্ড পাইরেসি এবং মেরিটাইম পাইরেসি হিউম্যানিটারিয়ান রেসপন্স প্রোগ্রাম রিপোর্ট করেছে যে পশ্চিম আফ্রিকার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত জাহাজের সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছেছে।

গিনি উপসাগরে জলদস্যুতা শতাব্দীর প্রথম দশকে বিকশিত হয়েছে। কিছু সময়ের জন্য, তেল অনুসন্ধানের সাথে জড়িত থাকার সাথে তেল কোম্পানিগুলির কর্মচারী এবং উপকরণগুলি নিয়ে আসা ছোট জাহাজগুলি নাইজেরিয়ায় ঝুঁকির মধ্যে ছিল। সময়ের সাথে সাথে জলদস্যুরা আরো আক্রমণাত্মক এবং উন্নত সশস্ত্র হয়ে ওঠে।

জলদস্যুতার কারণে বেনিন, টোগো, কোট ডি আইভরি, ঘানা, নাইজেরিয়া এবং কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নৌবাণিজ্যে ব্যাপক ক্ষতি করে৷ উদাহরণ স্বরূপ, বেনিনের প্রধান বন্দর, পোর্ট অফ কোটোনউ এর বাণিজ্য ৭০ শতাংশ কমে যায়। চুরি হওয়া পণ্য, নিরাপত্তা এবং বীমার কারণে গিনি উপসাগরে জলদস্যুতার খরচ প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে অনুমান করা হয়েছে। এই এলাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জলপথগুলোর একটি। এখানকার জলদস্যুদের সহজে ধরা যায় না। আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা সংস্থা (আইএমও) এই অঞ্চলে জলদস্যুতা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিলেও এখনো ফলাফল দেখা যায়নি।

পশ্চিম আফ্রিকা

আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিমে বিশেষ করে নাইজেরিয়ান জলদস্যুরা খুবই সক্রিয়। মেরিন কার্গো চলাচলের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত এটি। আফ্রিকার পশ্চিমের এই সমুদ্রপথে জলদস্যুরা এখানে বেশ বেপরোয়া। এখানে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। তাই জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় ও সোমালিয়ান জলদস্যুদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে। আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চল ও সোমালিয়ার জলদস্যুতার ঘটনাগুলোর মধ্যে বড় পার্থক্য হলো, পশ্চিম আফ্রিকার জলদস্যুরা সোমালিদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কাজ করে।

জলদস্যুতার হুমকির কারণে পশ্চিম আফ্রিকার পুরো সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে জাহাজগুলোর উচ্চ বীমা দরকার হয়।

দক্ষিণ চীন সাগর

দক্ষিণ চীন সাগরের জলদস্যুতার সাথে জড়িত মূলত ইন্দোনেশীয় এবং মালয়েশীয় জলদস্যুরা। মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমাতেই দুর্ধর্ষ এই দস্যুদের আক্রমণ বেশি হয়। এই জলদস্যুরা মালয়েশিয়া সরকারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

মালাক্কা প্রণালি

ভারত মহাসাগরে অবস্থিত মালাক্কা প্রণালি ঘিরে আছে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের এক প্রান্ত। সুয়েজখাল, মিসর আর ইউরোপের দিকে যাত্রাপথে এই প্রণালি পার হওয়ার সময় জলদস্যুরা জাহাজগুলো ধরে।

ইন্দোনেশিয়ার কাছে মালাক্কা প্রণালীতে জলদস্যুরা সাধারণত বন্দুক, ছুরি বা ছুরি দিয়ে সজ্জিত থাকে। আনাম্বাস, নাতুনা আর মেরুনডানগ দ্বীপে এদের উপদ্রব বেশি। এখানকার দস্যুরা দিনে নয়, রাতে আক্রমণ বেশি করে। যদি জাহাজগুলি একটি অ্যালার্ম বাজায়, জলদস্যুরা সাধারণত ক্রুদের মুখোমুখি না হয়েই চলে যায়। সিঙ্গাপুর প্রণালীতে জলদস্যুরা রাতের বেলা আক্রমণ করে, যখন জাহাজ চলছে বা নোঙর করে।

কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপের মতে, মালাক্কা প্রণালীতে জলদস্যুদের আক্রমণ ২০১৩ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বের উচ্চতায় পৌঁছেছিল, যা গিনি উপসাগরের অঞ্চলকে ছাড়িয়ে যায়। তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যৌথভাবে তাদের উপদ্রব কমিয়ে এনেছে।

আরবসাগর

আরবসাগরের ওমানের উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যুদের বেশি বিচরণ। এই এলাকা বারবার সামুদ্রিক জলদস্যুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এরপরেও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকার এডেন উপসাগর ও সোমালি উপকূলের মতো এখানকার নিরাপত্তা নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নয়। এ কারণে আরব সাগরে পণ্য পরিবহনে তাই মোটা অঙ্কের ইনস্যুরেন্স করতে হয়।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *