যেভাবে চুড়ান্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী

স্নায়ুযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে গত সাড়ে তিন দশ বিশ্বের অনেককিছুই নির্ভর করছে দেশটির শাসকদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হলেন দেশটির সরকার প্রধান। চার বছর পরপর সেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বচন হয়। বিশ্বের সব চেয়ে ক্ষমতাধর দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি নির্বচন নিয়ে বিশ্বজুড়ে থাকে ব্যাপক আগ্রহ। তবে এই নির্বচন প্রক্রিয়া কিন্তু কিন্তু বেশ জটিল ও লম্বা সময় নিয়ে চলমান একটি প্রক্রিয়া। আজ বহুরৈখিকে থাকছে কীভাবে দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে তা নিয়ে।

যেভাবে চুড়ান্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হলেন দেশটির সরকার প্রধান। রাষ্ট্রপতি সেদেশের ফেডারেল শাখাগুলোর নির্বাহী শাখাগুলোর প্রধান এবং তার দায়িত্ব হল সংবিধানের মাধ্যমে প্রদত্ত এবং কংগ্রেস কর্তৃক লিখিত রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় ধারার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে এবং তাকে দেয়া হয়েছে প্রভূত ক্ষমতা।

৪ বছর পর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে থাকে। একজন রাষ্ট্রপতি কেবল মাত্র দুইবার পূর্ণ মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হতে পারেন। এছাড়া কোনো কারণে রাষ্ট্রপতির পদ খালি হলে সেই দায়িত্ব যিনি গ্রহণ করবেন, তিনি এই মেয়াদের ২ বছর এবং পরে সর্বোচ্চ ২ মেয়াদের জন্য, এভাবে সর্বমোট ১০ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে কী যোগ্যতা প্রয়োজন এবং কী কী করতে হয়?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে হলে তিনটি প্রাথমিক যোগ্যতা থাকতে হবে। প্রথমত, জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ১৪ বছর বসবাসের প্রমাণ থাকতে হবে। এবং তৃতীয়ত, প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স ৩৫ বছর হতে হবে।

উপর্যুক্ত তিনটি যোগ্যতা থাকলে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের একটি ফরম পূরণ করে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার আবেদন করা যাবে এবং প্রচার কমিটির জন্য আরেকটি ফরম পূরণ করতে হবে। এর পরবর্তী ধাপ হচ্ছে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ভোট ব্যালটে নাম ওঠানো। এসব কিছু ঠিকমতো নিশ্চিত হয়ে গেলে প্রসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে আবেদনকারী অভিনন্দিত হবেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থিতা ঘোষণা করা হবে। তবে তখনো দলীয় চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা আসা বাকি। এর আগের কাজ প্রার্থীর তহবিল সংগ্রহ। সফল নির্বাচনী প্রচার করতে হলে মোটা অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করতেই হবে।

তহবিল সংগ্রহ প্রচার

প্রার্থিতা নিশ্চিত হওয়ার পর আবেদনকারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রচার শুরু করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আইন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যেকোনো ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী অথবা ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিতে পারেন।

এ ছাড়া একটু কম আইনি জটিলতার একটি পথ রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রার্থী তহবিল জোগাড় করতে পারেন। একে বলা হয় ‘সুপার প্যাক’। তবে অনেকে একে দুর্নীতির পথ বলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি বাকস্বাধীনতার প্রতীক।

অর্থ সংগ্রহের জন্য একজন প্রার্থীকে বড় বড় সমাবেশ করতে হয়, জাঁকালো ডিনারের আয়োজন করতে হয়, করমর্দন করতে হয় শত-সহস্র মানুষের সঙ্গে। সাম্প্রতিককালে অনেক প্রার্থী নির্বাচনী ওয়েবসাইট তৈরি করেন, যেখান থেকে অর্থ-সহায়তা নিয়ে থাকেন।

মোটকথা, নির্বাচন করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ে, তা প্রার্থীকে যে করেই হোক সংগ্রহ করতে হয়। নির্বাচনী প্রচারের জন্য কর্মকর্তা লাগে, কর্মী লাগে, কার্যালয় লাগে। সারা দেশে তাঁদের সফর করতে হয়, বিজ্ঞাপন করতে হয়, জরিপ-গবেষণা করতে হয়। এসব করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়ে।

আর কোন প্রার্থী কতটা তহবিল সংগ্রহ করতে পারছে তা ভোটারদের কাছে তার যোগ্যতা ও দক্ষতা হিসাবে প্রকাশ হয়। দলিয় প্রার্থী চুড়ান্ত করার সময় তহলিবের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়।

জরিপ বিতর্ক

কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হলে কেমন কাজ করবেন কিংবা কোনো সুনির্দিষ্ট প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হলে সেটা ভালো নাকি খারাপ হবে, তা ভোটারদের জানানোর একটি উপায় হচ্ছে টেলিভাইজড বিতর্ক।

টেলিভিশনে বিতর্কে প্রার্থীরা তাঁদের পরিকল্পনা জানানোর পর নির্বাচনী জরিপে তাঁদের সম্পর্কে ভোটারদের মতামত প্রতিফলিত হয়। এসব জনমত জরিপ করা হয় ভোটারদের ফোন করে, অনলাইনে মতামত নিয়ে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।

এ ছাড়া সমর্থন বাড়াতে প্রার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করেন। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, জনসংযোগসহ নানাভাবে তাঁরা নিজেদের পক্ষে ভোটার সমর্থন আনার চেষ্টা করেন।

এরপর দলীয় সমর্থন কোন প্রার্থীর পক্ষে কতটা, তা যাচাইয়ের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোতে পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয় প্রাইমারি ও ককাস নির্বাচন।

প্রাইমারি ককাস

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রাইমারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি দল তাদের নিজস্ব প্রার্থী বাছাই করে। এতে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও একে বলা হয় প্রাইমারি নির্বাচন, আবার কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে একে বলা হয় ককাস। যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম ককাস অনুষ্ঠিত হয় আইওয়া অঙ্গরাজ্যে।

ককাস হচ্ছে এমন একটি আলোচনা চক্র, যাতে নাগরিকরা একত্র হয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, বিতর্ক করেন এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁরা একজন প্রার্থী ঠিক করেন। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ককাসের ফল যোগ হয় সমন্বিত ফলাফলের সঙ্গে। ককাসের মতোই নির্বাচনে ঐতিহ্যগতভাবে প্রথম প্রাইমারি অনুষ্ঠিত হওয়া অঙ্গরাজ্য হচ্ছে নিউ হ্যাম্পশায়ার।

প্রাইমারি অনেকটা সাধারণ নির্বাচনের মতোই। এতে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে গোপন ব্যালটে ভোট দেন।

মূলত মঙ্গলবার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন। এর মধ্যে ‘সুপার টুইসডে’ নামে একটি মঙ্গলবার থাকে। এই সুপার টুইসডেতে একসঙ্গে অনেক অঙ্গরাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রাইমারি ও ককাসের ফল একসঙ্গে করে নির্বাচনী বছরের মাঝামাঝি সময়ে মোটামুটি প্রার্থিতার অনানুষ্ঠানিক ফল জানা যায়।

তবে আনুষ্ঠানিক প্রার্থিতা ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হয় দলীয় সম্মেলন পর্যন্ত।

রাজনৈতিক দল

১৮৫২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসছেন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দ্য রিপাবলিকান পার্টি অথবা দ্য ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে।

এই দুই দল ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে—দ্য লিবার্টারিয়ান, কনস্টিটিউশন, সোশ্যালিস্ট অথবা গ্রিনপার্টি। এ ছাড়া কেউ ইচ্ছা করলে স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় দলের শক্তি কখনোই খুব একটা বেশি দেখা যায় না। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের ভালো প্রভাব পড়ে। কারণ, তৃতীয় দলের প্রার্থী প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট নিয়ে নিতে পারেন।

দলীয় কনভেনশন

অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রাথমিক নির্বাচন ও ককাসের পর প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে অনুষ্টিত হয় দলীয় কনভেনশন। অঙ্গরাজ্যগুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে ডেলিগেট ঠিক হয়। দলীয় মনোনয়ন পেতে হলে একজন প্রার্থীর অবশ্যই ডেলিগেট ভোট জিততে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুপাতে।

এখানে উল্লেখ্য হলো, ডেলিগেট হচ্ছেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, যাঁরা দলের জাতীয় সম্মেলনে তাঁদের অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। বলা চলে, ভোটার নন, বরং কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে ডেলিগেটরাই দলের প্রার্থীদের চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করেন। ডেলিগেটরা যদি প্রার্থী নির্বাচন করেন, তাহলে ডেলিগেটদের কারা নির্বাচিত করেন?

এ বিষয়টি একটু জটিল। ডেলিগেট নির্বাচনের নিয়ম অঙ্গরাজ্যভেদে একেক রকম। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ভোটাররা সরাসরি ব্যালটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পাশাপাশি ডেলিগেটও নির্বাচন করেন। যেমন, ম্যারিল্যান্ড।

আবার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে প্রার্থীরা তাঁদের ডেলিগেট বাছাই করেন। অনেক অঙ্গরাজ্যে আবার দলীয় কনভেনশনের মাধ্যমে কিংবা দলীয় নেতাদের নিয়োগের মাধ্যমে ডেলিগেট নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ডেলিগেটরা দলের জাতীয় কনভেনশনে অংশ নেন। আর সেখানেই তাঁরা ভোটের মাধ্যমে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চূড়ান্ত করেন।

কোন প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছেন, তা দলীয় কনভেনশন শুরু হওয়ার আগেই বেশির ভাগ প্রাইমারি নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায়। আর সে ক্ষেত্রে দলীয় কনভেনশন হয়ে যায় প্রায় আনুষ্ঠানিকতা। কনভেনশনের মধ্য দিয়ে মূলত দলের প্রতি নেতাকর্মীদের আনুগত্য প্রকাশ পায়।

তবে যদি কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেলিগেট না পান, সে ক্ষেত্রে কনটেস্টেড কনভেনশন বা প্রতিযোগিতার সম্মেলন অনুষ্টিত হবে। এ ধরনের সম্মেলনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না আসা পর্যন্ত ডেলিগেটদের কয়েক দফা ভোটাভুটি হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেলিগেট ভোট যিনি পান, তাঁকে দলের প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *