ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া

রাশিয়া গত ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই আক্রমণটিকে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে, তিন দশমিক নয় মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে, এবং আরও লক্ষাধিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার অগ্রশনে রাশিয়ার ব্যাপক সমরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর সাথে সাথে রাশিয়া পড়েছে অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে। গেল তিন মাসে রাশিয়া কী অবস্থায় পড়েছে জানাচ্ছেন শামস্ বিশ্বাস

 

কীভাবে বদলে গেছে রাশিয়া

রাশিয়ায় স্বাভাবিক জীবন শেষ হয়ে গেছে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি – যেদিন ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দেন।

আন্তর্জাতিকভাবে এই হামলার ব্যাপক নিন্দা করা হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হামলার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং সম্পূর্ণভাবে হামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রাশিয়াকে সামরিক অভিযান স্থগিত করার নির্দেশ দেয় এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল রাশিয়াকে বহিষ্কার করে। অনেক রাষ্ট্র নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা রাশিয়া ও বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, এবং ইউক্রেনকে মানবিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে।

রাশিয়ার ভূখণ্ডে যুদ্ধ না চললেও আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই দেশটি আবার বদলাতে শুরু করেছে। মস্কোতে সবকিছুই স্বাভাবিক দেখালেও যুদ্ধ শুরুর গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়ায় সব স্বাধীন মিডিয়া হয় ব্লক করা হয়েছে না হয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদ হয়; রাশিয়ায় প্রতিবাদকারীরা গণগ্রেফতার এবং “যুদ্ধ” ও “আক্রমণ” শব্দগুলো নিষিদ্ধ করা সহ সংবাদ মাধ্যম সেন্সরশিপ বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়। অনেক কোম্পানি রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে তাদের পণ্য ও পরিষেবা প্রত্যাহার করে এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত মিডিয়া সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয় ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে।

রাশিয়ার বিভিন্ন স্থপনায় এখন বিশাল আকারের ‘Z’ (জেড) অক্ষর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যেটি এখন রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রতীক। ক্রেমলিনের সমালোচক বলে পরিচিত এমন বহু লোকজনের বাড়ির দরজায়, পাঁচিলে এই অক্ষর লেখা স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়েছে।

শপিং মলের বিদেশী ব্রান্ডের অধিকাংশ দোকান বন্ধ। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর শত শত বিদেশী কোম্পানি রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। সুপারমার্কেটে জিনিসের কমতি নেই। সমস্ত তাকই ঠাসা। কিন্তু যত ধরণের জিনিস ক’মাস আগেও দোকানে পাওয়া যেত ততটা এখন পাওয়া যাচ্ছেনা। গত দু’মাস জিনিসপত্রের দামও বেশ বেড়ে গেছে।

 

 

দেশত্যাগী ধনী রুশদের গন্তব্য দুবাই

ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার জন্য রুশ বিলিওনেয়ার এবং উদ্যোক্তারা দলে দলে হাজির হচ্ছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুবাইতে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দুবাইয়ের ভূসম্পত্তির দাম ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম ১০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ দু’লক্ষ রাশিয়ান নাগরিক দেশের বাইরে চলে গেছেন।

আমিরাতের সরকার রাশিয়ার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি এবং ইউক্রেনের ওপর হামরা চালানোর জন্য ক্রেমলিন সরকারের প্রতি কোন নিন্দাও জানায়নি। দলে দলে রাশিয়ান নাগরিক হাজির হওয়ায় দুবাই শহরের বিলাসবহুল ভিলা এবং অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা বেড়ে গেছে। দেশত্যাগি রাশিয়ানদের প্রধান শঙ্কা হচ্ছে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে। সেকারণে এরা তাদের অর্থ ও সহায়-সম্পত্তি রাশিয়া থেকে বের করে আনতে চাইছেন। যেসব রুশ দুবাইতে আসতে চাইছেন, তারা শুধু এখানে বিনিয়োগের কথাই ভাবছেন না। তারা দুবাইকে তাদের ‘সেকেন্ড হোম’ বা দ্বিতীয় আবাস হিসেবেও দেখছেন।

এরা ঐ শহরে বাড়ি কিনতে চাইছেন বলে সম্পত্তির দামও হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে বলে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট বা জমির দালালরা বলছেন।

অনেক বহুজাতিক সংস্থা এবং নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তাদের কর্মচারীদের দুবাইয়ে সরিয়ে আনছেন। রাশিয়া এবং ইউক্রেনে যাদের অফিস ছিল তারা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাদের শত শত কর্মচারীকে দুবাইয়ে সরিয়ে আনেন। তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বেছে নিয়েছেন এই জন্য যে সেখানে ব্যবসা চালানোর জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশ রয়েছে।

এদিকে নিজের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ জারি করেছে যে কোন রুশ নাগরিক ১০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি নগদ অর্থ নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে পারবে না। নগদ অর্থ সরাতে না পেরে অনেক ধনী রুশ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে মূল্য পরিশোধ করছে। দুবাইতে যারা ভিলা বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনছেন তাদের জন্য কাজ করছে বেশ কয়েকটি মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান। এরা রাশিয়ায় মূল খদ্দেরের কাছ থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অর্থ জমা নেয়, এবং দুবাইয়ে প্রপার্টি মালিককে নগদ অর্থে সেই মূল্য পরিশোধ করে।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য পশ্চিমা দেশগুলো যে অনুরোধ জানিয়েছিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশ সেটা নাকচ করেছে।

 

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েও রাশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে!

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের মুখে পড়েছে। রাশিয়ার অন্যতম রপ্তানিপণ্য তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তেল নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও বিবেচনা করছে ইইউ। সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রাশিয়ার ব্যাংক, আর্থিক সংস্থা ও বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটির অর্ধেক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করা হয়েছে।

 

তবে রাশিয়াও পাল্টা পদক্ষেপ দিয়েছে। দেশটি জাতীয় মুদ্রা রুবলের পতন ঠেকাতেও সক্ষম হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে।

 

এর পরেও ইউক্রেনে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েও রাশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। চলতি মে মাসের মাঝামাছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক এবং আর্থিক সেবা হোল্ডিং সংস্থা জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোং গ্রাহকদের দেওয়া এক বিবৃতিতে এমন তথ্য জানিয়েছে।

 

এর আগে রাশিয়ার অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস দেয় জেপি মরগান। তবে মার্কিন আর্থিক এবং ব্যবসায়িক সংবাদ ওয়েবসাইট বিজনেস ইনসাইডার বলছে, জেপি মরগান ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা বিবৃতিতে বলেন, তাঁদের হাতে যে তথ্য আছে, তাতে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

 

রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আরটির খবরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী ব্যাংকের বাণিজ্যিক জরিপ বলছে, রাশিয়ায় বড় ধরনের কোনো মন্দার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। এই জরিপ আরও বলছে, বিদ্যুৎ খরচ ও আর্থিক প্রবাহের উচ্চসূচকগুলো আভাস দিচ্ছে যে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা যতটা অনুমান করা গিয়েছিল, তার চেয়ে ভালো।

 

জেপি মরগান এর আগে আভাস দিয়েছিল রাশিয়ার জিডিপি এ বছর ৩৫ শতাংশ কমতে পারে। এসব পূর্বাভাস থেকে সরে এসেছে জেপি মরগান।

 

তবে জেপি মরগান এমনও বলছে, রাশিয়ায় নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। রাশিয়া যদি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু না করত তাহলে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ভালো থাকত।

জেপি মরগান ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা আরও বলছেন, রাশিয়ায় রপ্তানি কমছে। তাঁরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ভবিষ্যতে দেখা যাবে, তবে রাশিয়ায় খুব বেশি মন্দা হবে না।

 

রাশিয়ার আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) তথ্য বলছে, এ বছরের শুরু থেকে দেশটির তেল রপ্তানি খাতে রাজস্ব ৫০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আয় বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ায় তেল আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। ইইউ এবং যুক্তরাজ্য বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ার অপরিশোধিত সমস্ত ক্রয় বাতিল করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে এবং শেল এবং টোটাল এনার্জির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তেল কেনা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

 

রাশিয়ার তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের বাজারগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আইইএ বলছে, বিশ্বে রাশিয়ার তেল সরবরাহ গত মাসে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ ব্যারেল কমেছে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এটি তিন গুণ কমতে পারে।

 

‘রুবল’-এর নাটকীয় উত্থান

বেশ নাটকীয়ভাবে প্রবল নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল শক্তি ফিরে পেয়েছে। ইউক্রেনে ভ্লাদিমিন পুতিনের বিশেষ আভিযান শুরুর আগে রুবল যে অবস্থায় ছিল, এখন তার চেয়েও শক্তিশালী হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবসা ও অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ বলেছে, রুবল গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে।

ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর করার পরপরই ইউরোপ-আমেরিকার রাশিয়ার উপর নানা ধরণের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ফলে রুবলের মান বেশ দ্রুত নিচের দিকে পড়তে থাকে। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, অনেকে বিশেসজ্ঞ ভেবেছিল রাশিয়ার মুদ্রা রুবল দ্রুত মূল্যহীন হয়ে যাবে। ধারণা ছিল যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে যাবে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে, টানা দুই সপ্তাহ মস্কোর শেয়ার বাজার বন্ধ রাখা হয়েছিল। কারণ, শেয়ার বাজার খুললেই রুবলের দাম নিচের দিকে নামতো।

গেল মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে রুবল আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। রুবল ঘুরে দাঁড়ানোর মূল কারণ হচ্ছে, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানী। অর্থাৎ প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল রপ্তানি। রাশিয়ার রপ্তানি করা পণ্যের মধ্যে ৬০ শতাংশই হচ্ছে গ্যাস এবং তেল। এবং দেশটির রপ্তানি আয়ের ৪০ শতাংশ আসে তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে। ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাস এবং তেলের উপর উপর নির্ভরশীল। চুক্তিনুযায়ী রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপের দেশগুলো যে গ্যাস ও তেল ক্রয় করে সেটির মূল্য পরিশোধ করা হতো ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশসমূহের মুদ্রা ‘ইউরো’তে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে রাশিয়া বলেছে যে তাদের কাছ থেকে যারা তেল গ্যাস ক্রয় করবে, সেটির মূল্য পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে। এর ফলে ইউরোকে রুবলে পরিবর্তন করা হয়। গ্যাস এবং তেল আমদানি বাবদ রাশিয়াকে প্রতিদিন চল্লিশ কোটি ইউরো পরিশোধ করে ইউরোপের দেশগুলো। তাছাড়া চীন এবং ভারতের কাছে জ্বালানী বিক্রির মাধ্যমে রাশিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল -গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ কমলেও আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়া সেটি পুষিয়ে নিচ্ছে। ব্লুমবার্গ বলেছে, এ কারণে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল শক্তিশালী হয়েছে।

এ ছাড়া, রাশিয়ার উপর নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা দেবার কারণে দেশটি অনেক জিনিস আমদানি করতে পারছে না এবং রাশিয়ার মানুষ আগের মতো বিদেশে যেতে পারছে না। ফলে তাদের ডলার ও ইউরোর চাহিদা কমে গেছে।

এছাড়া রুবলের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে রাশিয়ার সরকার দেশের ভেতরে আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

যেমন, গেল ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার দ্বিগুণ করেছে। যারা রুবল বিক্রি করে ডলার বা ইউরো কিনবেন না, অর্থাৎ রুবল সঞ্চয় করবেন, তাদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে।

রাশিয়ার অনেক কোম্পানি বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যবসা করে ডলার, ইউরো এবং ইয়েন আয় করছে। এখন রাশিয়ার কোম্পানিগুলো বিদেশে ব্যবসা করে যে আয় করবে তার ৮০ শতাংশ রুবলে কনভার্ট করে নিতে হবে। এর ফলেও রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের একটি বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে।

যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের রাশিয়ায় কর্পোরেট শেয়ার এবং সরকারি বন্ড ক্রয় করা আছে। তারা যেন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরে সেগুলো বিক্রি করতে না পারে সে পদক্ষেপ নিয়েছে পুতিন সরকার। এর ফলে একদিকে যেমন রাশিয়ার স্টক ও বন্ড মার্কেটের পতন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা কাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যেতে পারেনি।

 

ইউক্রেনে হামলার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে!

ইউক্রেনে বিশেষ অভিযান শুরু করার পর রাশিয়ার জনগণের কাছে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

দেশটির বেসরকারি জনমত জরিপ সংস্থা লুভাদা’র জরিপে এ তথ্য জানা গেছে। খবর ব্লুমবার্গের।

লুভাদার জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ইউক্রেনে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়ার আগে ফেব্রুয়ারির  শুরুতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জনপ্রিয়তা ছিল ৭১ শতাংশ যা ইউক্রেন অভিযান শুরুর পর মার্চ মাসে ৮৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

এছাড়া, জনমত জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৭০ ভাগ রুশ নাগরিক মনে করেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে। এর আগের মাসে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ শতাংশ।

ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’শুরুর পরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে পশ্চিমা দেশগুলো। নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ মুদ্রা রুবলের মান পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার নাগরিকরা যে এখনও পুতিনের ওপরই আস্থা রেখেছেন তা জনমত জরিপে প্রকাশ পেয়েছে।

 

 

সঙ্কটজনক পুতিন, ভুগছেন ব্লাড ক্যানসারে’

প্রবল পরাক্রম দেখিয়ে ইউক্রেনে আক্রমন করলেও, তাঁর নিজের শারীরিক অবস্থা মোটেই ভাল নয় বলে শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটা, ঘন ঘন কাশি, কম্বলে নিজেকে মুড়ে রাখা, এ সবও নজর এড়ায়নি কারও। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শারীরিক অবস্থা নিয়ে এ বার চাঞ্চল্যকর তথ্য খোলসা করলেন সে দেশেরই এক ধনকুবের। তাঁর দাবি, পুতিনের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। তিনি ব্লাড ক্যানসারেভুগছেন।

গত মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘নিউ লাইনস ম্যাগাজিন’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই রুশ ধনকুবের পুতিনের অসুস্থতা এবং রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে মুখ খোলেন। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজের নাম-পরিচয় গোপন রাখার আবেদন জানান তিনি। তাতেই তিনি বলেন, “রাশিয়ার অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছেন পুতিন। শুধু রাশিয়াই নয়, ইউক্রেন-সহ আরও একাধিক দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছেন। আসলে ওঁর চিন্তাভাবনাই অন্যরকম। মস্তিষ্কের বিকৃতিতে গোটা পৃথিবী উল্টে দিতে পারেন।”

ওই ধনকুবেরের সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করেছে ‘নিউ লাইনস ম্যাগাজিন’। তাদের দাবি, বয়ান রেকর্ড করা হচ্ছে, তা জানতেন না ওই ধনকুবের। তাই সবকিছুই উগরে দিচ্ছিলেন তিনি। তাতেই পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়েও মন্তব্য করতে গিয়ে দ্বিধাবোধ করেননি। ১১ মিনিটের ওই অডিও রেকর্ডিং-কে সামনে রেখে ওই পত্রিকা রুশ ধনকুবেরের যে উদ্ধৃতি সামনে এনেছে, তা হল, “আমরা তো চাইছি, পুতিনের মৃত্যু হোক। ওঁর ক্যানসার ওঁকে খেয়ে নিক। নইলে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে অন্তত ওঁকে ক্ষমতা দেখে সরানো হোক।” ‘নিউ লাইনস ম্যাগাজিন’ জানিয়েছে, পুতিন যে ব্লাড ক্যানসারেই ভুগছেন, এমনটাও নির্দিষ্ট করে বলতে শোনা যায় ওই ধনকুবেরকে।

ওই ধনকুবের রাশিয়ার ২০০ বিত্তশালীদের মধ্যে একজন বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া সরকার যদি মনে করে কেউ ‘ভুয়ো খবর’ ছড়াচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। দেশের বাইরে থাকলেও সেই ঝুঁকি নিতে নারাজ ওই ধনকুবের। তাই নাম-ধাম প্রকাশ করতে চাননি ওই রুশ ধনকুবের।

তবে ওই ধনকুবের একা নন, এর আগে ইউক্রেনের শীর্ষ সেনা গুপ্তচরও পুতিন ক্যানসার আক্রান্ত বলে দাবি করেন। রাশিয়ার একটি স্বতন্ত্র সবাদমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমও জানায় যে, যেখানেই যান না কেন, সারা ক্ষণ তাঁর সঙ্গে তিন জন চিকিৎসক থাকেন। তাঁদের মধ্যে একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। সুস্থ হয়ে উঠতে সাইবেরিয়ার স্থানীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী, পুতিন বলগা হরিণের শিংয়ের রক্তে স্নানও করেন বলে দাবি করা হয় ওই রিপোর্টে।

 

পুতিনকে উৎখাতের গোপন অভিযান চলছে!

রাশিয়া যখন বিশ্বকে বিশ্বাস করাচ্ছে, ইউক্রেনে তারাই জিতবে, তখন ইউক্রেনের তরফে দাবি করা হল অসুস্থ পুতিনের পক্ষে যুদ্ধজয় সম্ভব নয়, এবং তিনি আর রাশিয়ার নেতৃপদে থাকতে পারবেন না। ইউক্রেনের এক শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তার দাবি, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উৎখাতের এক অভ্যুত্থান চলছে এবং এটাকে থামানো যাবে না।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মধ্যেই এমনটা দাবি করা হল। ইউক্রেন সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল কিরিলো বুদানভ এই দাবি করেছেন। বুদানভ ভবিষ্যদ্বাণীর সুরে বলেছেন, আগামী আগস্টের মাঝামাঝি এই যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড় নেবে। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ এই যুদ্ধ শেষ হবে। বুদানভ দাবি করেন, এই যুদ্ধে রাশিয়া হেরে গেলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সরিয়ে দেওয়া হবে, ভেঙে পড়বে রাশিয়া।

বুদানভ বলেন, এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় নেতৃত্বের পরিবর্তনের আসবে। এবং সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। পুতিনকে উৎখাত করার অভ্যুত্থান (ক্যু) চলছে কি না, জানতে চাইলে ইউক্রেনের এই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ‘হ্যাঁ, তা চলছে, এবং এটি বন্ধ করা অসম্ভব।’ বুদানভের আরও দাবি, পুতিন ক্যানসারে আক্রান্ত, তাঁর অন্য অসুস্থতাও আছে।

মেজর জেনারেল কিরিলো বুদানভ-এর দাবি, তিনি যে কাজে আছেন, তাতে তিনি না জানলে এসব আর কে জানবে!


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *