ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের এক বছর

দেখতে দেখেতে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বছর পার করল। যে কোনও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধেরই পরিণাম— অপরিমেয় মানবিক ট্র্যাজেডি। অসংখ্য ইউক্রেন-রুশ সেনা ও ইউক্রেনের নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মৃত্যু মিছিল, সে দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ধ্বংসপ্রাপ্তি, প্রাণভয়ে দলে দলে মানুষের ভিনদেশে উদ্বাস্তু শিবিরে অস্থায়ী আর অনিশ্চিত জীবনযাপন। বাকিদের দেশের মধ্যেই প্রতি মুহূর্তের মৃত্যুভয় নিয়ে খাদ্য, জ্বালানি, পানির তীব্র সঙ্কটের মধ্যে টিকে থাকার লাড়াই। বছর পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ, যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই। থামানোর জন্য, শান্তি প্রতিষ্ঠা বা যুদ্ধবিরতির জন্যও কোনও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেই। যুদ্ধের জেরে পুরো বিশ্ব তীব্র জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি, তবু সমঝোতার হদিস নেই। বরং, সঙ্কট জিইয়ে রাখার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রচেষ্টা টের পাওয়া যাচ্ছে। 

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের এক বছর

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট

১৯৯০-এর দশকে রাশিয়া-সহ পূর্ব ইউরোপে সমাজবাদের পতন তথা সোভিয়েট প্রজাতন্ত্র ভেঙে মধ্য এশিয়া থেকে ইউরোপে বহু ছোট-বড় নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভবে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয়—মার্কিন একাধিপত্যে ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’র সূচনায়। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে ইউক্রেন আলাদা হলেও পুতিনের রাশিয়া চেয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে বিশিষ্ট ভূরাজনৈতিক অবস্থানের ইউক্রেনে যাতে তার অনুগত সরকার থাকে। একই কারণে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আড়ালে পশ্চিমি দেশেগুলিও চেয়েছে ইউক্রেনে তাদের দিকে থেকে ঢলে-থাকা সরকার। ২০১৪-তে এক ‘সামাজিক বিপ্লব’-এর মধ্য দিয়ে রুশ-বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠা হলে, পুতিন ইউক্রেনের অন্তর্গত কৃষ্ণসাগর অন্তরীপের ক্রাইমিয়া দখল করেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি আরও পশ্চিমপন্থী। তাই, কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ‘নেটো’রও পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন। ফলে, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া বনাম পশ্চিমি শক্তিগুলির সংঘাত আবার নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে।

 

আরো ভয়াবহ যুদ্ধের প্রস্তুতি

ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাবাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগিনি প্রিগোজিন সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ আরো কয়েক বছর স্থায়ী হতে পারে।

‘পুতিনের শেফ’ হিসেবে পরিচিত ওয়াগনার প্রধানের যুদ্ধসংক্রান্ত মন্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইউক্রেনে কয়েক বছর বা দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন রাশিয়া।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান “ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার’ (আইএসডব্লিউ) রাশিয়ার দিক থেকে বড় ধরনের আক্রমণের পূর্বাভাস দিয়েছে। ইউক্রেনের সরকার বলেছেন, রাশিয়া আসছে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণের বর্ষপূর্তিতে বড় ধরনের আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে মস্কো হাজার হাজার সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং এই সৈন্যরা ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে কিছু একটা ঘটাতে পারে।

প্রতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সৈন্যরা ‘পিতৃভূমি রক্ষা দিবস’ বা ‘ডিফেন্ডার অব দ্য ফাদার ল্যান্ড ডে’ পালন করে। এই দিনটিকেও স্মরণীয় করে রাখতে প্রচেষ্টা চালাতে পারে রাশিয়া। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রেজনিকভ বলছেন, মস্কো সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য পাঁচ লাখ সেনার বহর সাজিয়েছে। ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের) মহাসচিব জেমস স্টলেন বার্জ সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেন, ইউক্রেনের পূর্বভাগ দখল করার ক্ষেত্রে পুতিনের সামরিক প্রস্তুতিতে কোনো রকম কমতি বা বিরতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। বরং ইরান ও উত্তর কোরিয়া থেকে আরও অস্ত্র এনে এবং গোলাবারুদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম প্রস্তুত করে বড় ধরনের যুদ্ধের আভাস দিচ্ছে রাশিয়া। আর এমনটা চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার কথা বলেছেন ন্যাটো প্রধান।

 

কার সমরশক্তি কেমন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসন নতুন করে ইউক্রেনে সমরাস্ত্র পাঠানোর জন্য ২.১৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। এই অর্থর বড় অংশ ব্যয় হবে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ যোগ্য ‘গ্রাউন্ড লাউঞ্চড স্মল ডায়ামিটার বোম’ (জিএলএসডিবি) নামক বিশেষ ধরনের রকেট ক্রয় ও ইউক্রেনে পরিবহন বাবদ। এর পাশাপাশি আরও পাঠাবে হাই মবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম (এইচআইএম আরএস)। রাশিয়ার অব্যাহত বিমান আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেন এবার পাচ্ছে আমেরিকার বিখ্যাত ‘হোমিং অল দ্য ওয়ে কিলার’ (এইচ এ ডব্লিউ কে) বা হাউক নামে অধিক পরিচিত ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইল।

২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স থেকে সর্বাধিক সমরাস্ত্র কিনেছে ইউক্রেন। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের শুরু থেকে ফ্রান্স ইউক্রেনের পাশে রয়েছে তার সব রকম যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে। গত জানুয়ারি তে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ শত্রুর ট্যাংকের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে কার্যকর ‘এএমএক্স-১০আরসি’ নামক ট্যাংক সদৃশ শক্তিশালী আর্মার্ড ফাইটিং ভেহিকেল ইউক্রেনে পাঠানোর এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ইউক্রেনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। ইংল্যান্ড ইতোমধ্যে ইউক্রেনে প্রচুর যুদ্ধ সামগ্রী পাঠিয়েছে। গত জানুয়ারির মাঝামাঝি ইংল্যান্ড আরও চৌদ্দটি চ্যালেঞ্জার ২ ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠানোর ঘোষণা দেন। জার্মানির সরকার ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ২৯টি লিওপার্ড-১ সিরিজের মেইন ব্যাটেল ট্যাংক (এমবিটি) প্রদানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তদুপরি জার্মানি আরও ১৪টি অত্যাধুনিক লিওপার্ড-২ দুই সিরিজের ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠাচ্ছে। এর বাইরে জার্মানির সামরিক কারখানায় কয়েক ডজন পুরনো ট্যাংক যুদ্ধোপযোগী করার প্রক্রিয়াও চলমান।

এর বাইরে প্রচুর গোলাবারুদ, সামরিক যান্ত্রিক যানবাহন, ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট, দূরপাল্লার মেশিনগান, রাডার, ড্রোন বিধ্বংসী সমরাস্ত্র, চিকিৎসা সামগ্রী ও সৈন্যদের জন্য শীতের পোশাকে নতুন রণসাজে সজ্জিত হচ্ছে ইউক্রেন সেনারা। এভাবেই ক্রমেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে আরও এগিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন।

উল্লেখ্য, এ বছরের শুরুতেই মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে ৩.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের যুদ্ধ সহায়তার ঘোষণা দেয়। ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর, এই ১০ মাসে বিশ্বের ৪৬টি দেশ ইউক্রেনে ১০৮.৮ বিলিয়ন ইউরো সমমূল্যের যুদ্ধ ও মানবিক সহায়তা প্রদান করে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা ছিল ৫১.৮ বিলিয়ন ইউরো ও খোদ মার্কিন সহায়তা ছিল ৪৭.৮ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিগত প্রায় এক বছরে ইউক্রেনকে নানাভাবে সামরিক যুদ্ধ সহায়তা প্রদানকারী দেশের শীর্ষ তালিকায় আরও রয়েছে বেলজিয়াম, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ইসরায়েল, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, স্পেন ও তুরস্ক। এর বাইরে বহু দেশ ও দাতা সংস্থা অর্থ ও মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে ইউক্রেনকে।

গত বছর থেকে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের সম্ভাবনার কথা বলে আসা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদেমিন পুতিন আবারও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, রাশিয়া সীমান্তে কেবল ট্যাংক বা লোহার বর্ম আচ্ছাদিত যুদ্ধযান পাঠাচ্ছে না, শত্রুকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার মতো রাশিয়ার আরও কিছু আছে। যারা রাশিয়াকে যুদ্ধের ময়দানে হারানোর আশা করছে, তারা সম্ভবত পুরোপুরি অনুধাবন করছেন না যে, এবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে আধুনিক যুদ্ধ তাদের জন্য হবে নতুন অভিজ্ঞতা।

 

পাল্টেছে ভূ-রাজনীতি

ইউক্রেনে রাশিয়ায় আক্রমণের পর প্রতিবেশি এই দুইদেশের দ্বন্দ সীমান্ত ছাড়িয়ে বিশ্ব ব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের পর আবারো নতুন মেরুকরণ হয়েছে!

গত বছরের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছিলেন, আমরা একটি বহু মেরুর বিশ্বে প্রবেশ করেছি যেখানে সবকিছুই অস্ত্র: জ্বালানি, ডাটা, অবকাঠামো, অভিবাসন। ভূ-রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, সবকিছুই ভূ-রাজনীতি।

এই যুদ্ধ সংঘাত ও মুখোমুখি অবস্থানকে আরও প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে ওয়াশিংটন ও বেইজিং-কেন্দ্রিক দেশগুলোর বিভক্ত হওয়া আরও বেড়েছে। ফ্রান্স-ভিত্তিক এফএমইএস থিংকট্যাংক-এর প্রধান পিয়েরে রাজৌক্স বলেন, এই বিশৃঙ্খল পুনর্গঠন বাস্তবতা কিন্তু হয়ত সাময়িক। অনিবার্যভাবে যুদ্ধের অবসান রাশিয়া ও ইউরোপকে দুর্বল করবে। একই সময়ে এই পরিস্থিতির বড় দুই সুবিধাভোগী হবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ২০০৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, একুশ শতকের গঠন হবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের ভিত্তিতে।

বেইজিংকে মস্কো সমর্থন করলেও পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় এমন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ এড়িয়ে গেছে দেশটি। কার্যত যুদ্ধের ফলে বেইজিংয়ের একটি করদ রাজ্য বা মুখাপেক্ষী হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে মস্কো। অর্থনীতিবিদ ও নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ আগাথি দেমারাইস বলেন, চীনের সঙ্গে দরকষাকষির মতো অবস্থায় নেই রাশিয়া। চীন যা চাইবে তা পেয়ে যাবে। কিন্তু রাশিয়া যা চাইবে তা দিতে হবে না। ২০৪৯ সালে বিশ্বের শীর্ষ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্যের আলোকে ইউক্রেন যুদ্ধকে বিবেচনা করছে চীন।

ক্রেমলিন চীনের প্রতি নির্ভরশীলতা সীমিত রাখতে তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান ও আফ্রিকায় নিজেদের ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও কৌশলগত সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনছে। রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার চীনের চেয়ে বড়, যা দেশটিকে পুরোপুরি চীনের অধীনস্থ হয়ে পড়া থেকে ঠেকাবে।

এশিয়ার মধ্যাঞ্চল, ককাস, বলকান, আফ্রিকা ও এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চল ছিল চীন, ইইউ, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র। অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন বা বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর, সামরিক বা কূটনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই লড়াই চলমান ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ সব কিছুকেই নাড়া দিয়েছে। মধ্য এশিয়ায় সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রভাব দুর্বল হয়েছে। এতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্ককে নতুন ভূমিকায় হাজির করেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এই যুদ্ধ সুযোগ ও ঝুঁকি নিয়ে এসেছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ যেমন রয়েছে তেমনি আবারও ওয়াশিংটনের ছায়ায় পেছনে থাকার ঝুঁকিও।

 

বিশ্ব অর্থনৈতে ভয়বহ প্রভাব

এশিয়া, আফ্রিকা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, উষ্ণতা ও আশ্রয়ের পেছনে ব্যয় বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে থেকেই জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে সংকট ছিল। করোনাভাইরাস মহামারির পর ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এই সঙ্কট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই প্রভাব কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার। এরপরেও গেল ২০২২ সালে প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় কমানোর জন্য নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে। বেশ কয়েকটি দেশে এসব বিক্ষোভ বৃহত্তর জাতীয় রাজনৈতিক সংকট, বড় ধরনের সহিংসতা, হতাহত ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবি তুলেছে।

সবচেয়ে বেশি ভুগছে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কারণ তাদেরকে বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে দরিদ্র দেশগুলোতে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সংকট তো ছিলই।

ইউক্রেনকে মার্কিন ও ইইউ’র নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের পক্ষ অস্ত্র পাঠানোর পাশাপাশি রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

পরাশক্তিগুলো এক সময় সর্বত্র মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে সোচ্চার ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারিতে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে আঘাত পড়েছে। মহামারির পর যুদ্ধে তা আরও বিপর্যস্ত হয়েছে।

সর্বনাশা ইউক্রেন-রুশ যুদ্ধের জেরে নতুন করে অস্ত্র-ব্যবসার পালে হাওয়া লেগেছে। তৈরি হয়েছে অস্ত্র-ব্যবসার আন্তজির্তিক অর্থনীতি। গেল নভেম্বরের মধ্যেই এই ব্যবসার কারবারিদের ব্যংক ব্যলেন্সে কমপক্ষে দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ হয়েছে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো-ভিত্তিক ইন দিস টাইমস ম্যাগাজ়িন জানাচ্ছে, ভার্জিনিয়ার সামরিক কোম্পানি, ‘রেথিয়ন’-এর সিইও, গ্রেগ হেস এবং ওয়াশিংটনের নিকটবর্তী মেরিল্যান্ডের অ্যারোস্পেস, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা বিষয়ক কোম্পানি, ‘লকহিড মার্টিন’-এর প্রধান, জিম টেকলেট তাঁদের অংশীদারদের ‘সুখবর’ দিয়ে জানাচ্ছেন যে, গত এক বছরে ইউক্রেন-রুশ দ্বন্দ্বে তাঁরা বিপুল পরিমাণে লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সময়েই, জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের নীতি— বেশি পরিমাণে অস্ত্রনির্মাণ না করার ‘জড়তা’ কাটিয়ে, নতুন করে সশস্ত্রীকরণের জন্য ১০০ বিলিয়ন ইউরো (জিডিপির ২ শতাংশ) বরাদ্দ করেছে, যার অনেকটাই রাশিয়াকে আটকাতে ইউক্রেনের হাতে যাবে। চেক প্রজাতন্ত্র-সহ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের বহু দেশের অস্ত্রের ব্যবসায়ীরা, স্নায়ুযুদ্ধর পর থেকে অব্যবহৃত গুদামঘরগুলি সারিয়ে আবার, ‘নেটো’র মান অনুযায়ী, কালাশনিকভ রাইফেল থেকে বিভিন্ন ক্ষমতার রকেট-লঞ্চার, গ্রেনেড, মর্টার তৈরি করে এতটাই মুনাফা করেছে যে, কারখানায় বাড়তি লোক নেওয়ার বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়েছে।

পশ্চিমে মারণাস্ত্র বানানোর এই কারবার প্রধানত চলে বেসরকারি উদ্যোগে, যাদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও তার পরিচালকরা ঘোষিত ও অঘোষিত স্বার্থের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্রব্যবসার ঘাঁটি মার্কিন মুল্লুক, যার ফলে   স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন দশক পেরিয়ে গেলেও অস্ত্র ব্যবসায়িদের হাসি আবার চওড়া হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার বড় যুদ্ধে। তাই বছর পেরোনো এই যুদ্ধ দ্রুত থেমে যাবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর পাঁচ তারকাবিশিষ্ট জেনারেল এবং ইউরোপে মিত্র সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার ১৯৬১ সাল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব শেষে তাঁর বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, দেশের সমরাস্ত্র নির্মাণ শিল্পকে যদি যথার্থ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে বিশ্বের কোনও-না-কোনও প্রান্তে চিরদিন যুদ্ধ চলতেই থাকবে!


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *