একটি বিয়ের পরিকল্পনা চাট্টিখানি কথা নয়। অনুষ্ঠান অনুযায়ী ভেন্যু, খাবারের মেন্যু ঠিক করা, বর-কনের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের পোশাক কেনা, যানবাহনের ব্যবস্থা করা, দাওয়াতপত্র ছাপানো, স্টেজ সাজানো, তত্ত্ব গোছানো, ছবি ভিডিও—আরো কত কী! বিয়ের অনুষ্ঠান যাঁরা একটু সুন্দরভাবে করতে চান অথচ নিজেদের অত সময় নেই, তাঁদের জন্য আছে ওয়েডিং প্ল্যানার। বিয়ের সার্বিক আয়োজন সুচারুভাবে সম্পন্ন করে দিতে অন্যের বিয়ের ঝামেলা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয় ওয়েডিং প্ল্যানার বা বিয়ে ব্যবস্থাপক। নিজের ভেতরে যদি সৃজনশীলতা থাকে এবং পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে তা হলে ক্যারিয়ার গড়া যেতে পারে একজন ওয়েডিং প্ল্যানার (Wedding Planner) হিসাবে। জাস্ট একটু ক্রিয়েটিভিটি আর হার্ডওয়ার্ক— এই দুইয়ের কম্বিনেশনে সফলতা মিলে ওয়েডিং প্ল্যানিংয়ের কেরিয়ারে। দর এবং চাহিদা দুইই দিন-দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওয়েডিং প্ল্যানারদের
দায়িত্ব
কিছুদিন আগে অবধিও বাড়িতে বিয়ের উৎসব লাগলে পরিবারের সদস্য-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব হাতে হাত মিলিয়ে সব আয়োজন করত। তবে এখন হাতে সময় কম আর ব্যস্ততাও বেশি। তবে গ্র্যান্ড ওয়েডিংয়ের স্বপ্ন অনেকেই দেখে। আর তাঁদের এই স্বপ্ন সত্যি করতে রয়েছেন ওয়েডিং প্ল্যানাররা। একটা বিয়েবাড়ির এ টু জেড আয়োজন এবং দেখাশোনার দায়িত্বে থাকে ওয়েডিং প্ল্যানাররা। বিয়েবাড়ির খুঁটিনাটি আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে শুরু করে বর-কনের সাজসজ্জা, বিয়েবাড়ির যাবতীয় কেনাকাটার পাশাপাশি অতিথি আপ্যায়ন, সবকিছুই সামলাতে হয় তাঁদের। অনেকসময় বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক করতে হতে পারে ওয়েডিং প্ল্যানারদের। সেক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট যে মতেই বিয়ে করতে চান না কেন সেই অনুযায়ী কাজি পুরোহিত বা ফাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করাও তাঁদেরই দায়িত্ব। ক্লায়েন্টের ক্ষমতা অনুযায়ী বিয়ের বাজেট তৈরি করাও একটা গুরুদায়িত্ব। নিমন্ত্রিতদের লিস্ট তৈরি করা, দাওয়াতের কার্ড ছাপানো, একে-একে দাওয়াতপর্ব সেরে ফেলার জন্য সঠিক যানবাহনের ব্যবস্থা করা, সবই থাকে ওয়েডিং প্ল্যানারদের দায়িত্বে। বিয়েবাড়ির ভেন্যু ঠিক করে সময় মতো বুকিং সেরে ফেলাটা খুব ইম্পরট্যান্ট। ক্যাটারারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্লায়েন্টের পছন্দ অনুসারে মেনু ঠিক করা, ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার, ডেকরেটর, মিউজিক ব্যান্ড ইত্যাদির ব্যবস্থাও সব পাকা করে রাখতে হয় ওয়েডিং প্ল্যানারদের। পাশাপাশি বিয়েবাড়ির অতিথিদের জন্য যাতায়াতের সুব্যবস্থা করা, বিয়ের দিন যাতে কোনও অসুবিধায় না পড়তে হয় তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে বসার জায়গা আর পানির ব্যবস্থা রাখার মত ছোটখাটো তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপরেও নজর রাখতে হয় তাঁদের। বিয়ের দিন বর-কনে তো বটেই, তাঁদের পরিবারের লোকজনেরাও চায় নিজেদের সেরা রূপে সকলের সামনে আসতে। সেইমতো তাঁদের জন্য ড্রেস এবং অ্যাকসেসরিজ শপিং করা এবং বিউটিশিয়ানকে অ্যাপয়েন্ট করার কাজও করে থাকেন প্ল্যানাররা। বাজেট ও চাহিদার ওপর নির্ভর করবে ওয়েডিং অনুষ্ঠান আয়োজনের সাজসজ্জা ও খরচাপাতি। গ্রাহকদের বাজেটই এখানে মুখ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুষ্ঠান আয়োজনে বিয়ের ব্যাপারে পরিবারের তেমন কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা থাকে না। সে কারণেই ওয়েডিং প্ল্যানার ওই বাজেটেই অপেক্ষাকৃত সফলভাবে আয়োজনটি করে দিতে পারে।
একজন ওয়েডিং প্ল্যানার যত বেশি সৃজনশীল হবেন, তার কাজ ততই ভালো হবে। মঞ্চ সাজানো থেকে শুরু করে বিয়ের প্রায় সব কাজেই সৃজনশীলতা জরুরি। মাথায় রাখা দরকার যে, বিয়ের অনুষ্ঠানটি একবারই হবে, চাইলেই অনুষ্ঠানটি আরেকবার করে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সর্বোচ্চ ভালোটি দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
দক্ষতা
বিয়ের অনুষ্ঠান সামলানো, মানে একবারে হাজার দায়িত্ব আর হাজার চিন্তার আনাগোনা। এ সময়ে বর-কনে বা তাদের অভিভাবকদের কাজের ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায় বলে সবকিছু ঠিকভাবে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় বিয়ের সার্বিক আয়োজন সুচারুভাবে সম্পন্ন করে দিতে তারা শরণাপন্ন হন ওয়েডিং প্ল্যানার বা বিয়ে ব্যবস্থাপকের কাছে। ওয়েডিং প্ল্যানিংয়ের পেশা খুব ইন্টারেস্টিং। তবে এ পেশার ক্ষেত্রে কোনও গতে বাঁধা ছক নেই। বেশিরভাগ কাজটাই নিজের সৃজনশীলতার উপর নির্ভর করে করতে হয়। তাই বলা যায় এক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভিটি ইজ দ্য কি ওয়ার্ড! ক্লায়েন্টের পরিবারের পছন্দ-অপছন্দ চট করে ধরে ফেলার ক্ষমতা থাকাটা বেশ জরুরি। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে কাজ করলে কাজটা আরও ভাল করে করা যায়। বিয়ে মানে একটা বিরাট উৎসব। এই উৎসবে সকলকে সামিল করে অনুষ্ঠানটিকে মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব থাকে ওয়েডিং প্ল্যানারদের হাতেই। অনেকসময় অনেক কম বাজেটের মধ্যেও কাজ করতে হয় তাঁদের। তার মধ্যেও নিজেদের আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে বিয়েবাড়িটা হিট করে দেওয়ার মধ্যেই ফুটে ওঠে তাদের দক্ষতা। অর্গানাইজেশনাল স্কিল এই পেশার ক্ষেত্রে খুব দরকার। কোন মার্কেটে কোন জিনিস সহজে পাওয়া যায়, এই বিষয়ে একটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। নিজেকে সঠিকভাবে মার্কেট করা এ পেশার মূলমন্ত্র। আর প্রফেশনালিজম এ পেশার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
যোগ্যতা
ওয়েডিং প্ল্যানিংয়ে আসতে গেলে শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে বেশি দরকার পেশাগত দক্ষতার। যে কোনও বয়স বা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই এই পেশায় আসা যায়। বিয়ের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান সে বিষয়ে একটা স্বাভাবিক জ্ঞান থাকা দরকার। তবে এই পেশায় বিভিন্ন ধরনের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ডিল করতে হয় আর তার মধ্যে বেশিরভাগই হাই প্রোফাইল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি তাই ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পাশ করা থাকলেই হবে। বিভিন্ন ধর্মের নিয়ম-কানুন আর বাকি সূক্ষ্ম বিষয়গুলির ব্যাপারে একটা সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। প্রথমে কোনও ট্রেনিং নিয়ে নিলে বা অন্ততপক্ষে কোনও নামী প্ল্যানারের অধীনে অ্যাসিস্ট করলে কাজের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা দুই-ই বাড়ে।
কাজের সুযোগ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওয়েডিং প্ল্যানিং এখন এক হিট কেরিয়ার। দেশের বাড় শহরগুলো যেমন ঢাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-সিলেটেও ইদানীং এই পেশার জনপ্রিয়তা লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। বেশ কিছু ওয়েডিং প্ল্যানার সংস্থাও গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক কালে। বাংলাদেশে এই ধরণের ওয়েডিং প্ল্যানার ফার্ম রয়েছে অন্তত ২০টির মত। যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজটি করছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে করছেন অনেকে। সেখানে কাজের সুযোগ তো অবশ্যই আছে পাশাপাশি চাইলে নিজে স্বনির্ভরভাবেও কাজ যায়। ভাল কাজ পাওয়ার জন্য ভাল পোর্টফোলিয়ো থাকা প্রয়োজন। নিজের আগের কাজের কিছু ছবি দিয়ে তৈরি করতে হয় এই পোর্টফোলিয়ো। এটা ক্যাটালগ হিসেবে কাজ করে। ক্লায়েন্টরা বেশিরভাগ সময়ে এই পোর্টফোলিয়ো দেখেই ওয়েডিং প্ল্যানার নির্বাচন করেন। এছাড়া ওয়েডিং প্ল্যানিং ছাড়াও ব্রাইডাল কনসালট্যান্ট হিসেবেও কাজ করতে পারেন তারা।
আয়রোজগার
ওয়েডিং প্ল্যানিং কেরিয়ারের ক্ষেত্রে কোনও বাঁধাধরা আয়ের অঙ্ক ধরে রাখা যায় না। বেশ কয়েকটা ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে তোমার পকেট কতটা ভরবে… এই পেশার ক্ষেত্রে একবার প্রতিষ্ঠা এবং নাম করতে পারলে রেট কার্ডেও পরিবর্তন আসে। তারপর নিজের টিমে কত জনকে নিয়োগ করছ তার উপরও নির্ভর করছে কতটা আয় হচ্ছে। তবে মোটামুটি বছরে দশ-বারোটা বিয়ে সুসম্পন্ন করতে পারলে কয়েকলাখ টাকা অবধি লাভ করা যায়। কোনও ওয়েডিং প্ল্যানিং সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকলে শুরুতে মাসিক ৫-১০ হাজার টাকা অবধি আয় করা যায়। পরবর্তীকালে সেটা ২৫ – ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত যেতে পারে। সংস্থার রেপুটেশনের উপরও অনেকটা নির্ভর করে।
Leave a Reply