চা শিল্প | উন্নয়ন সময় | শিল্পোন্নয়নে বাংলাদেশ

চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এক সময় চা রপ্তানিতে শীর্ষে থাকলেও, কয়েক বছরের ব্যবধানে চা আমদানির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বের পঞ্চম চা রপ্তানিকারক দেশের রপ্তানি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শূন্যের কোটায় নেমে আসবে চা রপ্তানি।

 

চা শিল্প

পানিকে বাদ দিলে চা হল বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়। প্রতিদিন সারা বিশ্বে গড়ে দুই বিলিয়ন কাপ চা পান করা হয়। স্নিগ্ধ, প্রশান্তিদায়ক স্বাদের জন্য বিশ্বজুড়ে চয়ের এত প্রসার। ইংরেজিতে চা-এর প্রতিশব্দ হলো টি (TEA)। গ্রীকদেবী থিয়া (Theia)-এর নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়। চীনে ‘টি’-এর উচ্চারণ ছিল ‘চি’। পরে হয়ে যায় ‘চা’। চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। ‘চা পাতা’ কার্যত চা গাছের পাতা, পর্ব ও মুকুলের একটি কৃষিজাত পণ্য যা বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুত করা হয়। চা মৌসুমি অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। একপ্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা হয়। চা প্রধানত ৩ ধরনের যথা- চীনা চা, আসামী চা ও ইন্দো-চীনা-চা। প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া অনুসারে চা-কে পাঁচটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন – কালো চা, সবুজ চা, ইষ্টক চা, উলং বা ওলোং চা এবং প্যারাগুয়ে চা। এছাড়াও, সাদা চা, হলুদ চা, পুয়ের চা-সহ আরো বিভিন্ন ধরণের চা রয়েছে। তবে সর্বাধিক পরিচিত ও ব্যবহৃত চা হল সাদা, সবুজ, উলং এবং কাল চা। প্রায় সবরকম চা-ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে তৈরি হলেও কিছু-কিছু চায়ে ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থাকে না; যেমন ভেষজ চা।

 

 

ফিরে দেখ

চীন দেশই চায়ের আদি জন্মভূমি। ১৬৫০ সালে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ সালে। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম ক্লাবে দেশে প্রথম চা চাষের প্রথা শুরু হয়। সিলেটের চাঁদখানি টিলায় ১৮৫৬ সালের ৪ জানুয়ারি দেশীয় জাতের চা গাছের সন্ধান মেলে। একই সময়ে খাসি ও জৈন্তা পাহাড়েও ‘বন্য প্রজাতির’ চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। প্রধানত ব্রিটিশ (ইংরেজ, স্কটিশ, আইরিশ) চা-মালিকরা সিলেটের টিলাভূমিতে ব্যাপক এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদনের সূচনা করে। বাংলাদেশের চা বাগানগুলির মালিকানা প্রধানত তিন ধরণের, ক) স্টারলিং কোম্পানি, খ) বাংলাদেশি কোম্পানি এবং গ) ব্যক্তি মালিকানা। যে সকল চা বাগানের মালিক ইউরোপীয় বিশেষত ব্রিটিশ তাদেরই বলা হয় স্টারলিং কোম্পানি। দেশীয় যে সকল কোম্পানি ১৯১৩ সালের কোম্পানি অ্যাক্ট দ্বারা গঠিত সেগুলো বাংলাদেশি কোম্পানি। স্টারলিং কোম্পানির চা বাগানগুলি আয়তন ও চা উৎপাদনের দিক থেকে বৃহত্তম (গড় আয়তন ১৬৪৮ একর)। এরপর রয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন বাগান (গড় আয়তন ৬৬৯ একর) এবং সবচেয়ে ছোট বাগানগুলি মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন (গড় আয়তন ৩৪৩ একর)।

 

চা শিল্প বিকাশে বঙ্গবন্ধুর অবদান

বাংলাদেশের চা শিল্পের বিকাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই সময় তাঁর উদ্যোগে চা শিল্পের চাষাবাদ, কারখানা উন্নয়ন এবং শ্রম কল্যাণের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং কার্যকর উদ্যোগের ফলে চা’য়ের উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চা শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন হয়।

 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে চা শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অধিকাংশ চা কারখানা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে। ফলে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, জনবল স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত উৎপাদন উপকরণ, ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা যন্ত্রপাতি, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কারণে চায়ের উৎপাদন ও গুণগতমান ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সরকারের কার্যকারী পদক্ষেপের ফলে এই বিধ্বস্ত শিল্প পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়। স্বাধীনতাত্তোর সরকার চা শিল্পের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য চা বাগানগুলোর পুনর্বাসন, নতুন চা এলাকা সম্প্রসারণ, চা কারখানা আধুনিকীকরণ, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ জোরদারকরণের লক্ষ্যে কয়েকটি সম্ভাব্য সমীক্ষা পরিচালনা করে। এ সময়ে চা শিল্পের পুনর্বাসন ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ সচিবালয়কে অনুরোধ জানান। স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের উৎপাদিত চা কেবল মাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্রয় করা হতো। এ সময়ে চা সেখানকার বাজার উপযোগী করে তৈরি করা হতো। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের একক ও সুরক্ষিত বাজার হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে চায়ের নিলাম মূল্য উৎপাদন খরচের নিচে নেমে যায়। এসময় সরকার বিকল্প রপ্তানি বাজার অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেন।

চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ৩০ লক্ষ ভারতীয় মুদ্রা মূল্যের ঋণ নিয়ে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বঙ্গবন্ধু চা বাগান মালিকদেরকে ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করেন।

 

মেড ইন বাংলাদেশ

আফগানিস্তান, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, চেক, ফ্রান্স, গ্রীস, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, ভারত, ইরান, জাপান, জর্ডান, কুয়েত, কাজাখিস্তান, মিশর, ওমান, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, রাশিয়া, স্লোভাক প্রজাতন্ত্র, সুদান, সাইপ্রাস, সুইজারল্যান্ড, উজবেকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভৃতি দেশে রফতানি করা হয়। বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপী সিলেট টী নামে খ্যাত।

 

বাংলাদেশের চা

চা গাছের জন্য অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও তাপের প্রয়োজন হয় বলে বাংলাদেশের বৃষ্টিবহুল পাহাড়িয়া অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চায়ের চাষ করা হয়। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশে প্রায় শূন্য দশমিক ৮১ ভাগ জিডিপি অর্জিত হয় চা শিল্প থেকে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বে চা রপ্তানির তালিকায় বাংলাদেশ ছিল পঞ্চমে। ২০০০ সালে বিশ্বের ৩০টি চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল নবম উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে। ২০০৮ সালে তা নেমে আসে ১১তম স্থানে। ২০১৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ৩৫টি চা রফতানিকারক দেশের মধ্যে শীর্ষ স্থান হারিয়ে ফেলে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ ও মানুষের চা পানের প্রবণতা বৃদ্ধি ও অভ্যাস পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে তুলনায় চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি না-পাওয়ায় ১৯৮৪ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।

বর্তমানে ১৬৬ টি চা বাগান এবং ৭৪৬ ক্ষুদ্র চাষীসহ মোট ভূমির পরিমাণ এক লক্ষ ১৬ হাজার ১৮৬ দশমিক ৮৮ হেক্টর। চা চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৬৬ হাজার ৫২ দশমিক ৩৫ হেক্টর। তন্মধ্যে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫৯ হাজার ৫৫৪ দশমিক ৩৫ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনা হয়েছে। অন্যান্য ভাবে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৫০ হাজার ১৩৪ দশমিক ৫৩ হেক্টর। দেশের অধিকাংশ চা বাগান মৌলভীবাজার জেলায়। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯০টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি এবং হবিগঞ্জে ২৩টি চা বাগান রয়েছে। এছাড়া চা শিল্পের সম্ভাবনাময় জেলা পঞ্চগড়ে ৭টি এবং রাঙামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি করে চা বাগান রয়েছে। একুশ শতকে বাংলাদেশ অরগ্যানিক টী পঞ্চগড়ে চা উৎপাদন করা শুরু করেছে। দেশের বেশির ভাগ চা বাগান কয়েক দশকের পুরনো হওয়ায় চায়ের উৎপাদন ভোগের তুলনায় দিন দিন কমে যাচ্ছে। চা শিল্পের সাথে বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ ৩৩ হাজার জন শ্রমিক জড়িত। তাদের পোষ্য সংখ্যা প্রায় ছয় লক্ষ ৬৫ হাজার। চা উৎপাদনকারীরা চা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে এই এক লক্ষ ৩৩ হাজার শ্রমিকের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। প্রায় ছয় লক্ষ ৬৫ হাজার মানুষের ভরণপোষণ অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। এতে সামাজিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হতে পারে।

 

রপ্তানি আয়

১৯৭২ সালে চায়ের মোট রফতানি ছিল প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ কেজি, যা টাকার অংকে ছিল ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার। বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার কেজি। এ সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে পণ্যটি ভোগের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি। ফলে ওই বছরে ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার কেজি চা রফতানি করা সম্ভব হয়েছিল। আর রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছিল প্রায় ৮৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে এ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার কেজিতে। এর বিপরীতে ভোগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার কেজিতে। এ সময়ের ব্যবধানে দেশে ভোগ তথা ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যটির ব্যবহার বেড়েছে ১৩২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর বিপরীতে উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কমেছে রফতানির পরিমাণও। গত বছর বাংলাদেশ থেকে পণ্যটি রফতানি হয়েছে মাত্র ২৫ লাখ ৬০ হাজার কেজি। অর্থাৎ প্রায় দেড় দশকের ব্যবধানে রফতানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ।

 

রপ্তানিকারক যখন আমদানিকাররক

চা বাগান এবং বাংলাদেশের চা শিল্প দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। এক সময় যে দেশ চা রপ্তানিতে সমৃদ্ধ ছিল, কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই দেশ চা আমদানির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শূন্যের কোটায় নেমে আসবে চা রপ্তানি।

তথ্যমতে, ২০১২ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ চা আমদানি হয়েছে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন কেজি। ২০১১ সালে প্রায় তিন মিলিয়ন কেজি চা আমদানি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে আমদানি হয়েছে প্রায় সাত মিলিয়ন কেজি। ২০১৭ সালে তা এসে দাঁড়ায় প্রায় ৬০ লাখ কেজিতে। এ বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য প্রতিকূলে যাচ্ছে।

আগামীতে চা আমদানির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে জানান আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। চা আমদানিকারকরা জানান, মূলত ইন্দোনেশিয়া থেকে চা আমদানি হচ্ছে বাংলাদেশে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, চীন ও ভারত থেকে কিছু কিছু চা বাংলাদেশে আসছে। এসব দেশ উচ্চ ফলনশীল জাতের চা চাষের ফলে তাদের উৎপাদন বাড়িয়েছে। পাশাপাশি কম মূল্যে তারা রপ্তানি করতে পারছে। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন চা কোম্পানি এখন চা আমদানির দিকে ঝুঁকছে। আমদানিকাদের অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃপক্ষের তদারক না থাকায় চা বাগানের জন্য বরাদ্দকৃত জমি ভিন্ন কাজে ব্যবহার করছেন বাগান মালিকরা। এ কারণেই ধীরে ধীরে চায়ের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

 

প্রতিবন্ধকতা

এক সময় চা আমাদের গৌরবময় রপ্তানি পণ্য ছিল। চা রপ্তানি কমার কারণ হিসেবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বেশি করে দায়ী করা হচ্ছে। বাংলাদেশে চা উৎপাদনে এই অসাম্যতা ও নিম্নমুখিতার জন্য বিভিন্ন কারণ দায়ী। সময়ের বিবর্তনে উৎপাদনের নিম্নগতি, অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্রমবৃদ্ধি এবং চা উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার ফলে চায়ের রপ্তানি হ্রাস পায়। বর্তমানেও বাংলাদেশের চা শিল্প বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চা বাগানগুলোর বয়স বৃদ্ধি পাওয়া, চায়ের জন্য জমি ইজারা নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করা, পুরনো জাতের বীজের ব্যবহার অব্যাহত থাকা, আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া না লাগা, চা বাগানে কর্মরতদের জীবনমানের উন্নতি না হওয়া, অপর্যাপ্ত অর্থায়ন, উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, অনুন্নত ও অপ্রতুলতা অবকাঠামো এবং শ্রমিক অসন্তোষ অন্যতম। এ ছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয়করণ, চা উৎপাদনের জন্য অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, মান নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, দুর্নীতি, বিশ্বায়নের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে চা শিল্প আশানুরূপ বিকাশ লাভ করতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এক কথায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পের উদ্ভূত সমস্যাগুলোর পরিত্রাণই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় অর্জন।

 

সফলতা

পিতার মতো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চা শিল্পের বিকাশে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন। তার নেতৃত্বে গঠিত প্রথম সরকার (১৯৯৬-২০০১) চা শিল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ রেন। কিন্তু পরবতীতে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামাতের নেতৃতাধীন জোট সরকার সেসব উদ্যোগ বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। শেখ হাসিনা নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার (২০০৯-১৪ এবং ২০১৪-১৮) তার দুই মেয়াদে চা শিল্পের রফতানির সুদিন ফিরিয়ে আনতে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ নেয়য় চা শিল্পের জন্য প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নানা বিধ প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও চা রোপণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, কারখানা উন্নয়ন, উৎপাদন প্রক্রিয়া সুসংহতকরণ, শ্রমকল্যাণ, চা বাগান পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এগুলো মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য কয়েকটি হল:

  • চা উৎপাদন ১৯৭০ সালের ৩১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি থেকে ২০১৪ সালে ৬৩ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন কেজিতে উন্নতকরণ;
  • চা চাষের জমি পরিমাণ ১৯৭০ সালের ৪২ হাজার ৬৩৭ হেক্টর থেকে ২০১৪ সালে ৫৮ হাজার ৭১৯ হেক্টরে উন্নতকরণ;
  • চা বাগানের সংখ্যা ১৯৭০ সালের ১৫০টি থেকে ২০১৪ সালে ১৬৬ টিতে উন্নতকরণ;
  • চায়ের উৎপাদনশীলতা ১৯৭০ সালের ৬৩৯ কেজি/হেক্টর থেকে ২০১৪ সালে ১২৩০ কেজি/হেক্টরে উন্নতকরণ;
  • ২৪৫৬.২৫ হেক্টর জমি শস্য বহুমুখীকরণ এবং বিকল্প কাজে ব্যবহার;
  • এক হাজার ৯৬৬ দশমিক ৪৪ হেক্টর জমিতে পরিকল্পিত বনায়ন;
  • শতাধিক জনকে বিদেশে উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান;
  • ১৮ টি উচ্চ ফলনশীল ক্লোন উদ্ভাবন;
  • ৪টি বাইক্লোন এবং ১টি পলিক্লোন জাত তৈরি;
  • সমগ্র বাংলাদেশে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় মোট ১ লক্ষ ১ হাজার ৭২৪ হেক্টর ক্ষুদ্রায়তন চা চাষযোগ্য জমি চিহ্নিতকরণ;
  • বান্দরবন, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় এক হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ;
  • অভ্যন্তরীণ ভোগ ৬৪ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত হয়েছে যা দেশীয় উৎপাদন দ্বারা মেটানো হচ্ছে;
  • ৩৯ টি চা বাগানে ৩৯ টি বাঁধ/জলাধার নির্মাণ;
  • ৬৬ টি চা বাগানে ৬৬ টি সেচ যন্ত্র প্রদান; এবং
  • চা বাগনে ব্যবহৃত কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ (Residue) নিরূপণের জন্য ১ টি পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
  • মতিঝিলে ৩০ তলাবিশিষ্ট ‘বঙ্গবন্ধু চা ভবন’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।
  • কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ও পেস্টিসাইডস ব্যবহার না করে অর্গানিক পদ্ধতিতেও চা উৎপন্ন করা হচ্ছে।
  • বিভিন্ন বাগানে সিটিসি ব্ল্যাক টি-এর পাশাপাশি গ্রিন টি ও অর্থোডক্স টি তৈরি করা হচ্ছে।
  • চায়ের মোড়কজাত ও বাজারজাতকরণে এসেছে নতুনত্ব।

এ ছাড়া চা শিল্পের বিকাশে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে একটি চা জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। চা বাগান বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকেও বিকশিত করেছে অনেকাংশে। কেননা প্রতিবছর দেশী-বিদেশী পর্যটকরা সিলেটসহ পাহাড়ি অঞ্চলে এবং চা চাষযোগ্য এলাকাতে ভ্রমণ করতে আসেন, যা দেশীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব চিত্র বহির্বিশ্বে তুলে ধরছে।

এ অর্জনে সরকারের কার্যকর নীতি এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দৃঢ় অঙ্গিকার ও নিরলস প্রচেষ্টা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে।

 

উন্নয়নের পথ নকশা: বাংলাদেশ চা শিল্প

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং কার্যকর উদ্যোগে ফলে অচিরেই বাংলাদেশ রফতানির শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করবে। চা শিল্পের উন্নয়নে তার সরকার ২০১৬ সালে ‘উন্নয়নের পথনকশা : বাংলাদেশ চা শিল্প’ শিরোনামে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদা মেটানো ও রপ্তানি বাড়াতে ১৫ বছরের এই কৌশলগত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে দেশে বর্তমানে চায়ের উৎপাদন প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। আর এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২৫ সালে দেশে চায়ের মোট উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ১৪ কোটি কেজি।

এই মহপরিকল্পনায় ১০টি প্রকল্প প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই প্রকল্পের মধ্যমে চা বাগানে অব্যবহৃত চা চাষযোগ্য জমিতে চা সম্প্রসারণ, অনুন্নত চা বাগানের উন্নয়ন, চা চাষাধীন অলাভজনক জমি পুনরাবাদ, চা বাগানের কারখানা সুষমকরণ ও আধুনিকীকরণ, প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট জোরদারকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট জোরদারকরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, চা বাগানের সেচ সুবিধা বর্ধিতকরণ, চা বাগানের শ্রমিক কল্যাণ এবং চা বাগানের ব্যবস্থাপনা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন।

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বৃহদায়তনের চা বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তনের জমিতে চায়ের চাষ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। দেশের সাতটি জেলার প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চা আবাদের লক্ষ্য হাতে নেয়া হয়েছে। এখানকার আরো ৪ হাজার ৬৯৮ হেক্টর অনাবাদি জমিতে আরো ১ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করা সম্ভব। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন, যার সিংহভাগই ঋণের ভিত্তিতে এবং বাকি কিছু অর্থ অনুদান বা প্রকল্প সহায়তার মাধ্যমে সংস্থান করা হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চায়ের শ্রেণিবিন্যাস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সাধারণ কালো চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠাণ্ডা চা, সুগন্ধি চা, মসলাযুক্ত চা, ঔষধি চায়ের মতো বিশেষ ক্যাটাগরির চা রফতানি করা হবে। রফতানিযোগ্য চা বস্তায় নয়, উন্নত মোড়কে প্যাকেটজাত এবং চায়ের উৎপাদন ও গুণাগুণ-সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্যাবলিসহ রফতানি করা হবে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের চা রফতানি করা সম্ভব হবে। বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের চায়ের গৌরব পুনরুদ্ধার হবে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *