চা শিল্প
পানিকে বাদ দিলে চা হল বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়। প্রতিদিন সারা বিশ্বে গড়ে দুই বিলিয়ন কাপ চা পান করা হয়। স্নিগ্ধ, প্রশান্তিদায়ক স্বাদের জন্য বিশ্বজুড়ে চয়ের এত প্রসার। ইংরজিতে চা-এর প্রতিশব্দ হলো টি (TEA)। গ্রীকদেবী থিয়া (Theia)-এর নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়। চীনে ‘টি’-এর উচ্চারণ ছিল ‘চি’। পরে হয়ে যায় ‘চা’। চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। ‘চা পাতা’ কার্যত চা গাছের পাতা, পর্ব ও মুকুলের একটি কৃষিজাত পণ্য যা বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুত করা হয়। চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। একপ্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা হয়। চা প্রধানত ৩ ধরনের যথা- চীনা চা, আসামী চা ও ইন্দো-চীনা-চা। প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া অনুসারে চা-কে পাঁচটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন – কালো চা, সবুজ চা, ইষ্টক চা, উলং বা ওলোং চা এবং প্যারাগুয়ে চা। এছাড়াও, সাদা চা, হলুদ চা, পুয়ের চা-সহ আরো বিভিন্ন ধরণের চা রয়েছে। তবে সর্বাধিক পরিচিত ও ব্যবহৃত চা হল সাদা, সবুজ, উলং এবং কাল চা। প্রায় সবরকম চা-ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে তৈরি হলেও কিছু-কিছু চায়ে ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থাকে না; যেমন ভেষজ চা।
ফিরে দেখ
চীন দেশই চায়ের আদি জন্মভূমি। ১৬৫০ সালে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ সালে। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম ক্লাবে দেশে প্রথম চা চাষের প্রথা শুরু হয়। সিলেটের চাঁদখানি টিলায় ১৮৫৬ সালের ৪ জানুয়ারি দেশীয় জাতের চা গাছের সন্ধান মেলে। একই সময়ে খাসি ও জৈন্তা পাহাড়েও ‘বন্য প্রজাতির’ চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। প্রধানত ব্রিটিশ (ইংরেজ, স্কটিশ, আইরিশ) চা-মালিকরা সিলেটের টিলাভূমিতে ব্যাপক এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদনের সূচনা করে। বাংলাদেশের চা বাগানগুলির মালিকানা প্রধানত তিন ধরণের, ক) স্টারলিং কোম্পানি, খ) বাংলাদেশি কোম্পানি এবং গ) ব্যক্তি মালিকানা। যে সকল চা বাগানের মালিক ইউরোপীয় বিশেষত ব্রিটিশ তাদেরই বলা হয় স্টারলিং কোম্পানি। দেশীয় যে সকল কোম্পানি ১৯১৩ সালের কোম্পানি অ্যাক্ট দ্বারা গঠিত সেগুলো বাংলাদেশি কোম্পানি। স্টারলিং কোম্পানির চা বাগানগুলি আয়তন ও চা উৎপাদনের দিক থেকে বৃহত্তম (গড় আয়তন ১৬৪৮ একর)। এরপর রয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন বাগান (গড় আয়তন ৬৬৯ একর) এবং সবচেয়ে ছোট বাগানগুলি মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন (গড় আয়তন ৩৪৩ একর)।
মেড ইন বাংলাদেশ
আফগানিস্তান, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, চেক, ফ্রান্স, গ্রীস, জার্মানি, হাঙ্গেরী, ইতালি, ভারত, ইরান, জাপান, জর্ডান, কুয়েত, কাজাখস্তান, মিশর, ওমান, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, রাশিয়া, স্লোভাক প্রজাতন্ত্র, সুদান, সাইপ্রাস, সুইজারল্যান্ড, উজবেকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভৃতি দেশে রফতানি করা হয়। বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপী সিলেট টী নামে খ্যাত।
বাংলাদেশের চা:
চা গাছের জন্য অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও তাপের প্রয়োজন হয় বলে বাংলাদেশের বৃষ্টিবহুল পাহাড়িয়া অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চায়ের চাষ করা হয়। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে চা উৎপাদনে ১১তম। দেশে প্রায় শূন্য দশমিক ৮১ ভাগ জিডিপি অর্জিত হয় চা শিল্প থেকে। বর্তমানে চায়ের বার্ষিক উৎপাদন ছয় কোটি ৬২ লাখ ৬০ হাজার কেজি। চা বোর্ডের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, উৎপাদিত চায়ের ৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণেই ব্যবহার হচ্ছে। রপ্তানি করা হচ্ছে মাত্র ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বাকি চার দশমিক ৯৩ শতাংশ চা ভোগ ও রপ্তানির জন্য সংরক্ষিত হয়। বর্তমানে প্রতিবছর বাংলাদেশে চা উৎপাদন এক দশমিক ৩৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ ও মানুষের চা পানের প্রবণতা বৃদ্ধি ও অভ্যাস পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ তিন দশমিক ৮৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সে তুলনায় চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি না-পাওয়ায় ১৯৮৪ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে রপ্তানীর পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে ৪৭,৭৮১ হেক্টর জমিতে ১৬৩টি চা বাগান রয়েছে, যার অধিকাংশ মৌলভীবাজার জেলায়। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯০টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি এবং হবিগঞ্জে ২৩টি চা বাগান রয়েছে। এছাড়া চা শিল্পের সম্ভাবনাময় জেলা পঞ্চগড়ে ৭টি এবং রাঙামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি করে চা বাগান রয়েছে। একুশ শতকে বাংলাদেশ অরগ্যানিক টী পঞ্চগড়ে চা উৎপাদন করা শুরু করেছে। দেশে বড় চা বাগানগুলো ছাড়াও ২৫৭ জন ক্ষুদ্র চাচাষি-খামারির আওতায় মোট এক লাখ ১৫ হাজার ৭৮৪ হেক্টর জমির মধ্যে ৬২ হাজার ২৯৭ হেক্টর চা চাষযোগ্য জমি রয়েছে। এর মধ্যে চা চাষ হয় ৫৫ হাজার ৮৫৭ হেক্টর জমিতে। এটা মোট চাষযোগ্য জমির ৮৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অবশিষ্ট ৫৩ হাজার ৪৮৭ হেক্টর জমিতে এখনো চা চাষ শুরু হয়নি। দেশের বেশির ভাগ চা বাগান কয়েক দশকের পুরনো হওয়ায় চায়ের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ লোক চা শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। যার মধ্যে প্রায় এক লক্ষ ৫০ হাজার শ্রমিকই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
রপ্তানি আয়
২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ১ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রফতানি করে ২২ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা আয় করা হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা।
রপ্তানিকারক যখন আমদানিকাররক
চা বাগান এবং বাংলাদেশের চা শিল্প দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। এক সময় যে দেশ চা রপ্তানিতে সমৃদ্ধ ছিল, কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই দেশ চা আমদানির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বের পঞ্চম চা রপ্তানিকারক দেশটির রপ্তানি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শূন্যের কোটায় নেমে আসবে চা রপ্তানি। চা রপ্তানি কমার কারণ হিসেবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বেশি করে দায়ী করা হচ্ছে। এছাড়া দেশে চায়ের উৎপাদন কমে যাওয়া, দেশীয় বাজারে চায়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়া, চা বাগানগুলোর বয়স বৃদ্ধি পাওয়া, চায়ের জন্য জমি ইজারা নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করা, পুরনো জাতের বীজের ব্যবহার অব্যাহত থাকা, আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া না লাগা, চা বাগানে কর্মরতদের জীবনমানের উন্নতি না হওয়া, দলীয়করণসহ নানা কারণে দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চা বোর্ড ও চা রপ্তানিকারকদের সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে এ দেশ থেকে ৮৫ লাখ কেজি চা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। পরের বছর তা মারাত্মকভাবে কমে দাঁড়ায় ৩২ লাখ কেজিতে। ২০১০ সালে চা রপ্তানির পরিমাণ আরও কমে হয় ১০ লাখ কেজি। ২০১১ সালে চা রপ্তানির পরিমাণ আবার বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ লাখ কেজিতে। আর গত বছরও একই পরিমাণ চা রপ্তানি হয়। রাপ্তানি কমার বিপরীতে বাড়ছে আমদানি। গত ২০১২ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ চা আমদানি হয়েছে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন কেজি। ২০১১ সালে প্রায় তিন মিলিয়ন কেজি চা আমদানি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে আমদানি হয়েছে প্রায় সাত মিলিয়ন কেজি। এ বছর চা আমদানির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে জানান আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। চা আমদানিকারকরা জানান, মূলত ইন্দোনেশিয়া থেকে চা আমদানি হচ্ছে বাংলাদেশে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, চীন ও ভারত থেকে কিছু কিছু চা বাংলাদেশে আসছে। এসব দেশ উচ্চ ফলনশীল জাতের চা চাষের ফলে তাদের উৎপাদন বাড়িয়েছে। পাশাপাশি কম মূল্যে তারা রপ্তানি করতে পারছে। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন চা কম্পানি এখন চা আমদানির দিকে ঝুঁকছে। আমদানিকাদের অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃপক্ষের তদারক না থাকায় চা বাগানের জন্য বরাদ্দকৃত জমি ভিন্ন কাজে ব্যবহার করছেন বাগান মালিকরা। এ কারণেই ধীরে ধীরে চায়ের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশে চা উৎপাদনে এই অসাম্যতা ও নিম্নমুখিতার জন্য বিভিন্ন কারণ দায়ী। এর মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ অন্যতম। এ ছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতা, চা উৎপাদনের জন্য অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অবকাঠামোগত সমস্যা, মান নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, দুর্নীতি, বিশ্বায়নের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে চা শিল্প আশানুরূপ বিকাশ লাভ করতে পারেনি। এক কথায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পের উদ্ভূত সমস্যাগুলোর পরিত্রাণই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় অর্জন।
সম্ভাবনা
চা উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের রূপকল্প-২০২১ বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ চা বোর্ড ৯৬ হাজার ৭৩৫ দশমিক ৭০ লাখ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে ১২ বছর মেয়াদী একটি কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। উক্ত টাকার মধ্যে ৮৩ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৯৭ লাখ টাকা সহজ শর্তে ঋণ এবং ১৩ হাজার ২৫৫ দশমিক ৭৩ লাখ টাকা অনুদানের সংস্থান রাখা হয়েছে। সরকারের নীতি এবং ভিশন-২০২১কে সামনে রেখে পরিকল্পনাটি তিন পর্যায়ে (৫ বছর+২ বছর) বাস্তবায়িত হবে। পরিকল্পনায় ১০টি প্রকল্প প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই প্রকল্পের মধ্যমে চা বাগানে অব্যবহৃত চা চাষযোগ্য জমিতে চা সম্প্রসারণ, অনুন্নত চা বাগানের উন্নয়ন, চা চাষাধীন অলাভজনক জমি পুনরাবাদ, চা বাগানের কারখানা সুষমকরণ ও আধুনিকীকরণ, প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট জোরদারকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট জোরদারকরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, চা বাগানের সেচ সুবিধা বর্ধিতকরণ, চা বাগানের শ্রমিক কল্যাণ এবং চা বাগানের ব্যবস্থাপনা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন। সাথে সাথে চায়ের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১১৫৬২৯.৭৬ হেক্টর থেকে বর্ধিত করারও প্রচেষ্টা চলছে। চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের চেষ্টায় বর্তমানে চায়ের ১৮টি উচ্চ ফলনশীল ক্লোন, ৪টি বায়োক্লোনাল ও ১টি পলিক্লোনাল বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে; যা অধিক চা উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া চা শিল্পের বিকাশে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে একটি চা জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। চা বাগান বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকেও বিকশিত করেছে অনেকাংশে। কেননা প্রতিবছর দেশী-বিদেশী পর্যটকরা সিলেটসহ পাহাড়ি অঞ্চলে এবং চা চাষযোগ্য এলাকাতে ভ্রমণ করতে আসেন, যা দেশীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব চিত্র বহির্বিশ্বে তুলে ধরছে।
Leave a Reply