
ভূমিকা
হরমুজ প্রণালি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী এই সংকীর্ণ জলপথ বিশ্বের তেল ও গ্যাস বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরান ও আরব উপদ্বীপের মাঝে অবস্থিত এই প্রণালি মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এর কৌশলগত অবস্থান এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এটিকে বিশ্ব অর্থনীতির একটি স্পর্শকাতর পয়েন্টে পরিণত করেছে। ইরান বারবার এই প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, বিশেষ করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার সময়। এই লেখায় প্রণালির গুরুত্ব, বন্ধ হলে সম্ভাব্য ক্ষতি, বন্ধ করার সম্ভাব্যতা এবং পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

নামকরণ ও বুৎপত্তি
হরমুজ প্রণালির নামটির উৎস সম্ভবত পারস্যের রাজা দ্বিতীয় শাপুরের মা ইফরা হুরমিজদের নাম থেকে এসেছে, যিনি ৩০৯ থেকে ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ১ম শতকের নাবিকদের গাইডবুক এরিত্রিয়ান সাগরের পেরিপ্লাস-এ পারস্য উপসাগরের প্রবেশপথের বর্ণনা রয়েছে, তবে প্রণালির নাম উল্লেখ নেই। ১০ম থেকে ১৭শ শতাব্দীতে এখানে হরমুজ রাজ্য ছিল, যা নামকরণের একটি সম্ভাব্য উৎস। ভাষাবিদদের মতে, “হরমুজ” নামটি ফারসি শব্দ হুর-মঘ থেকে এসেছে, যার অর্থ খেজুর গাছ। এটি জরাথ্রুষ্ট্রীয় দেবতা হরমুজ (অহুর মাজদা) নামের সঙ্গে মিল থাকায় এই দুটির মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব
হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ মাত্র ৩৪ কিলোমিটার প্রশস্ত, এবং নৌযান চলাচলের চ্যানেল প্রায় ১০ কিলোমিটার। মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের (EIA) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রতিদিন প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং তেলজাত দ্রব্য এই পথে পরিবহন করা হয়, যা বিশ্বের তেল বাণিজ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এছাড়াও, কাতার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (LNG) একটি বড় অংশ এই পথে রপ্তানি হয়।
এই প্রণালি এশিয়ার দেশগুলো (চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া), যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাপান তার আমদানিকৃত তেলের তিন-চতুর্থাংশ এবং চীন তার অর্ধেক তেল এই পথে আমদানি করে। সৌদি আরব প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ ব্যারেল তেল এই প্রণালি দিয়ে রপ্তানি করে। ইরাক, কুয়েত, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল রপ্তানির একটি বড় অংশও এই পথে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর এই প্রণালির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত টহল দেয়।
ইরানের উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে এটি ইরানের জন্য একটি কৌশলগত হাতিয়ার। ইরান এই প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি স্পর্শকাতর পয়েন্ট।

হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে সম্ভাব্য ক্ষতি
হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও শক্তি বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো হলো:
- তেলের দামে উল্লম্ফন: গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, প্রণালি বন্ধ হলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটি উৎপাদন খরচ বাড়াবে এবং খাদ্য, পোশাক ও রাসায়নিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে।
- অর্থনৈতিক মন্দা: চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলো মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার তেল আমদানির ৬০% এবং চীনের অর্ধেক তেল এই প্রণালির উপর নির্ভরশীল।
- আঞ্চলিক অস্থিরতা: প্রণালি বন্ধ হলে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইরানের সংঘাত বাড়তে পারে, যা আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করবে।
- বিকল্প পথের সীমাবদ্ধতা: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানের পাইপলাইনগুলো হরমুজ প্রণালির তুলনায় মাত্র ১৫% তেল পরিবহন করতে পারে।
- চীনের উপর প্রভাব: চীন, যারা ইরানের ৯০% তেল আমদানি করে, এই প্রণালি বন্ধ হলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- জ্বালানি নিরাপত্তার ঝুঁকি: তেল আমদানিনির্ভর দেশগুলোর শিল্প উৎপাদন, পরিবহন ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটবে।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা সম্ভব কি?
ইরান বারবার প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, বিশেষ করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার সময়। তবে, এটি বন্ধ করা বাস্তবসম্মত কি?
সম্ভাব্য পদ্ধতি
ইরানের কাছে প্রণালি বন্ধ করার বিভিন্ন কৌশল রয়েছে:
- নৌ মাইন স্থাপন: ইরান নৌ মাইন ব্যবহার করে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে পারে, যেমনটি ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে করেছিল।
- জাহাজে হামলা বা জব্দ: ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (IRGC) দ্রুতগামী নৌকা, সাবমেরিন বা অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
- ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: ইরান ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
- নৌ মহড়া বা হুমকি: সামরিক মহড়ার মাধ্যমে শিপিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা যেতে পারে।
চ্যালেঞ্জ
ইরান সাময়িকভাবে বাধা সৃষ্টি করতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রণালি বন্ধ রাখা কঠিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দ্রুত সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জলপথ পুনরায় খুলতে পারে। ইরান নিজেও এই প্রণালির মাধ্যমে তেল রপ্তানি করে, তাই বন্ধ করলে নিজেদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীনের মতো আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এর বিরোধিতা করবে।
পাল্টা ব্যবস্থা
প্রণালি বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নিতে পারে:
- সামরিক হস্তক্ষেপ: মার্কিন পঞ্চম নৌবহর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দ্রুত অভিযান চালিয়ে প্রণালি খুলতে পারে।
- অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা: ইরানের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
- কৌশলগত তেল মজুদ: যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান তাদের তেল মজুদ ব্যবহার করে সাময়িক ঘাটতি মোকাবিলা করতে পারে।
- কূটনৈতিক চাপ: চীন, ভারত ও জাতিসংঘ ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে।

প্রণালি বন্ধের অনুমোদন
ইরানের পার্লামেন্ট প্রণালি বন্ধ করার প্রস্তাব সমর্থন করলেও, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (IRGC) তার নির্দেশে অভিযান পরিচালনা করবে।
উপসংহার
হরমুজ প্রণালি বিশ্ব অর্থনীতি ও শক্তি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বন্ধ হলে তেলের দাম বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দা ও আঞ্চলিক অস্থিরতা দেখা দেবে। ইরানের এটি বন্ধ করার ক্ষমতা থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা বজায় রাখা কঠিন। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংকট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদে প্রণালির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।
Leave a Reply