ডাক্তাররা রোগ প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারেন কিন্তু মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য যা যথেষ্ট নয়৷ দরকার পাবলিক হেলফ বা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। রোগ প্রতিকারের সাথে সাথে পাবলিক হেলথ তাই রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ জন্য বর্তমানে পাবলিক হেলফ বা জনস্বাস্থ্যে গ্রাজুয়েটের চাহিদা বাড়ছে।
পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে- মানুষের রোগ নিয়ে গবেষণা ও প্রতিরোধে পদ্ধতি-ব্যবস্থাপনার আবিষ্কার। গোটা জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি গ্রহণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করাই পাবলিক হেলথের কর্মীদের কাজ। সামগ্রিকভাবে রোগব্যাধির ঝুঁকি কমিয়ে আনাই পাবলিক হেলথ কেয়ারের উদ্দেশ্য। তাই এখানে ডাক্তার, নীতিনির্ধারক, ফার্মাসিস্ট, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণের অংশগ্রহণ জরুরি।
পাবলিক হেলথ কি?
পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যে এমন একটা বিজ্ঞান এবং শিল্প যা ব্যক্তি, সম্প্রদায়, সমাজ, সংস্থা ও সমাজে বিরাজমান আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, মানব স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং দীর্ঘায়িত সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। পাবলিক হেলথের প্রধান ভিত্তি হলো একটি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য এবং সাথে সাথে যেসকল ঝুঁকি বিরাজমান তার বিশ্লেষণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই জনগণ হতে পারে হাতে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ, একটি পুরো গ্রাম অথবা একটি পুরো মহাদেশ। আর স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতাকে বুঝায়। শুধুমাত্র রোগ না থাকাই যে সুস্থতা এমন নয়। পাবলিক হেলথ আরো অনেকগুলো আন্তঃসম্পর্কিত বিষয়ের সাথে জড়িত। এমনটাই দাবি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।
পাবলিক স্বাস্থ্যের লক্ষ্য হলো জীবনের গুণগত মানের উন্নতি করা- সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা, এবং রোগের সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে। মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও এর সাথে জড়িত। আর এটা তখন সম্ভব হবে যখন রোগের নজরদারি এবং সুস্থতার লক্ষণ গুলো সঠিকভাবে সনাক্ত করা হবে। পাবলিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য যেসকল পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সেগুলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো, সঠিকভাবে হাত ধোঁয়া, নিয়মিত মাতৃদুগ্ধ পান , সঠিক সময়ে টিকাদান , আত্মহত্যার ব্যাপারে সচেতনতার সৃষ্টি এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যৌনবাহিত রোগ যাতে না ছড়ায় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি।
পাবলিক হেলথ-এর গুরুত্ব
বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাবলিক হেলথ কেয়ার বিষয়ে নানামুখী গবেষণা ও শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। বিভিন্ন দেশে এই শিক্ষা পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্ট কিংবা পাবলিক হেলথ এডুকেশন নামে পরিচিত। এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবং বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন- বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জিকা, কলেরা, বসন্ত, মহামারি মোকাবেলায় পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ও নেতৃত্ব তৈরি করা। এই লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনএফপিএ, ইউএনডিপি ছাড়াও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা পাবলিক হেলথ নিয়ে গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সেখানে বহু লোকজনের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের পাবলিক হেলথের ডিগ্রিধারীরা হাভার্ড, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পাচ্ছে। তাই পাবলিক হেলথের গ্রাজুয়েটদের স্বপ্নময় ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে।
কাজের সুযোগ
পাবলিক হেলথ শিক্ষার্থীদের জন্য গ্লোবাল ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয় এ বিষয়ে পড়ে। পাবলিক হেলথের বহু গ্রাজুয়েট বর্তমানে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় দেশে-বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরি করছে। দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়েও প্রতিনিধিত্ব করছে পাবলিক হেলথের ছাত্ররা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনএইডস, ইউএনএফপিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউএসএইডের বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োগে বর্তমানে পাবলিক হেলথের ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (আইএনজিও) যেমন- আইসিডিডিআরবি, সেভ দ্য চিলড্রেন, এফএইচআই-৩৬০, আইডিআরসিতে কর্মসংস্থান হয়েছে এই বিষয়ের শিক্ষার্থীদের। জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা প্রজেক্ট, ওয়াটার এইড ও কেয়ারের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজের সুযোগ হচ্ছে বাংলাদেশী ডিগ্রিধারীদের। পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্টের ছাত্ররা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে সবচেয়ে বেশি ফেলোশিপ পাচ্ছে।
যোগ্যতা
সাধারণত এমবিবিএস ডিগ্রীধারীরা পাবলিক হেলথ অফিসার হিসেবে কাজ করেন। এক্ষেত্রে পাবলিক হেলথ বা গণস্বাস্থ্য বিষয়ে যাদের মাস্টার্স ডিগ্রী আছে তারা অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচ্য হন। এমবিবিএস ডিগ্রী লাভের পরেই তাই এখন অনেককে দেখা যায় গণস্বাস্থ্য বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী হতে। তবে সবক্ষেত্রে এমবিবিএস ডিগ্রী থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যারা ব্যাচেলর ডিগ্রী অন্য কোন বিষয়ের উপরে লাভ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র গণস্বাস্থ্য বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী থাকলেই চলবে। গবেষণার কাজ বলে এখানে নিয়োগের জন্য কোন বয়সসীমা এবং অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা থাকে না। তবে ভালো ফলাফল এবং পূর্বে গণস্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত কোন বিষয়ের উপরে অভিজ্ঞতা বা ভালো জ্ঞান থাকলে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া যায়।
পড়াশুনা
বাংলাদেশে পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়ালেখার শুরু ১৯৭৮ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিনে (নিপসম) তে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপিএই ডিগ্রি দেয়া হতো। শুধু ডাক্তার ও সরকারি কর্মকর্তারা এই ডিগ্রি নেয়ার সুযোগ পেতেন। ২০০৬ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ বিষয়ক প্রোগ্রাম শুরু হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৩১টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্সটিটিউটে পাবলিক হেলথ শিক্ষা কিংবা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে।
আয় রোজগার
সাধারণত একজন পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটের মাসিক বেতন ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকা হয়ে থাকে। তবে বেতনের বিষয়টি কাজ ও প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সদ্য ডিগ্রীপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাসিক ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতনেও নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
ক্যারিয়ার গ্রাফ
একজন পাবলিক হেলথ অফিসার পদোন্নতির মাধ্যমে সিনিয়র রিসার্চ অফিসার পদে উন্নীত হন। সিনিয়র রিসার্চ অফিসার থেকে ধীরে ধীরে পদোন্নতি হয়ে রিসার্চ ফেলো ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো পদগুলো পার করার মাধ্যমে একজন রিসার্চ অফিসার সর্বোচ্চ সায়েন্টিস্ট, হেড সায়েন্টিস্ট অথবা প্রফেসর পদে উন্নীত হতে পারেন।
Leave a Reply