রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সেবা জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে রাজনীতিবিদগণের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াই হলো লোকপ্রশাসন বা পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। দেশের প্রায় সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়টি পড়ানো হয়। দক্ষ সরকারী ও বেসরকারি প্রশাসক তৈরিতে এই সাবজেক্টটির অবদান অনস্বীকার্য। সকল ক্ষেত্রেই প্রশাসন একটি অতীব জরুরী উপাদান তাই প্রশাসনযন্ত্র শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগ চালু হয়। তুমুল সম্ভাবনাময়ী বিষয় ‘লোকপ্রশাসন’ নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস্ বিশ্বাস।
লোকপ্রশাসন কী
সরকার প্রণীত নীতি ও আইনসমূহের জনকল্যাণার্থে বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই হলো লোকপ্রশাসন বা পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।
শিশুর জন্মলাভ করার পর জন্ম নিবন্ধন, জীবন রক্ষা, শিক্ষাজীবন এবং শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিক্রম করে সবোর্চ্চ ডিগ্রি লাভ, কমর্জীবন শুরু করা, পারিবারিক জীবনে প্রবেশ, কমর্জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করা ও অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা, ভোগ এবং অবশেষে মৃত্যুবরণ, পরে মৃত্যুজনিত সনদ প্রদান, মানুষের ব্যক্তিজীবনের সামগ্রিক বিষয়ই লোক-প্রশাসন দ্বারা প্রভাবিত। সহজ কথায় বলতে গেলে লোক প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সরকার এবং সরকারের কার্যক্রমের এমন কোন বিশেষ জায়গা নেই যেটি লোক প্রশাসনের বাইরে। এর পরিধি অনেকটা বিস্তৃত। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এটি। লোকপ্রশাসন সামাজিক বিজ্ঞানের বহুল প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এ বিষয়টি এখনও সমাজ বিজ্ঞান অথবা গণমুখী বিষয়রূপে বিকাশমান।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে লোকপ্রশাসন স্বতন্ত্র একটি বিভাগ বা অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন হলেন লোকপ্রশাসনের জনক। উনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে লোকপ্রশাসনকে স্বতন্ত্র বিবেচ্য বিষয় হিসেবে পৃথক করেন। ১৮৮৭ সালের “প্রশাসনের অধ্যয়ন” শিরোনামের একটি নিবন্ধে তিনি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে লোকপ্রশাসনকে স্বীকৃতি দেন।
কেন পড়বেন লোকপ্রশাসন?
পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্যই একটি – সেটি হলো জ্ঞান অর্জন। লোকপ্রশাসনও পড়বেন জ্ঞানার্জনের জন্যে। লোকপ্রশাসনে পড়ে নিজের তাত্ত্বিক বিষয়েই নয়, বরঞ্চ সার্বিক জ্ঞানের একটা চমৎকার মিথস্ক্রিয়া পাবেন। লোকপ্রশাসন এমন একটি বিষয় যা নিজের কর্মগন্ডি সমৃদ্ধ করে ব্যবসায়ে প্রশাসনেও নিজের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। কলাতেও নিজের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা ছোট থেকে বড় বিষয়েই লোকপ্রশাসনের ভূমিকা রয়েছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থার সাহায্যেই প্রত্যেকটা সংগঠন চলছে, সেটা পরিবার থেকে শুরু করে ব্যবসা কর্পোরেশন থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত। সুতরাং বলাই বাহুল্য, লোকপ্রশাসন আপনাকে সার্বিক জ্ঞানের একটি কমপ্যাক্ট উপহার দিচ্ছে। আপনি এখান থেকে যে তাত্ত্বিক জ্ঞান পাবেন তা আপনার জীবনের প্রত্যেকটা ধাপেই কাজে লাগাতে পারবেন। এটি আপনার ক্যারিয়ারের জন্যেও সহায়ক বটে।
লোকপ্রশাসন যারা পড়ে তাদের বলা হয় ‘Navigator Of The Nation’. যাদের দেশ ও জনগনের সেবা করার মানসিকতা রয়েছে, তাদের লোকপ্রশাসন পড়া উচিত। বিশাষ করে আমাদের দেশের মতো দেশগুলোতে এটা বেশি প্রয়োজন। কাজের বিনিময়ে উপরি পাওয়ার মানসিকতা যাদের নেই তাদেরই লোকপ্রশাসন পড়া উচিৎ। সে বিজ্ঞান, ব্যবসা কিংবা মানবিক যে শাখারই হোক না কেন। একজন প্রশাসনিক ব্যক্তি সততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করলে প্রতিষ্ঠান যেমন লাভবান হয়, তেমনই ব্যাপকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। সেবার ব্রত ধারণ করা, দেশ ও জনগণকে নিয়ে চিন্তাশীল মানু্ষদেরই এই বিষয়ে পড়া উচিৎ।
লোকপ্রশাসন সাবজেক্টটি সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত অন্যতম উচ্চ পর্যায়ের সাবজেক্ট হিসেবে গন্য হয়ে থাকে। সরকারের পলিসি প্ল্যানিং থেকে পলিসি ফর্মুলেশন, সরকারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষন এবং ম্যানেজমেন্ট, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন ইত্যাদি হচ্ছে লোক প্রশাসনের ফোকাস এরিয়া। বিষয়টি এখনো সমাজবিজ্ঞান অথবা গণমুখী বিষয় রূপে বিকাশমান।
কোথায় পড়বেন
লোকপ্রশাসন থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা BSS (Bachelor of Social Science) এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা MSS (Master of Social Science) ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন।
লোকপ্রশাসন বিভাগটি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও সরাসরি এই নামে নেই। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কোনো কলেজেও এটির পাঠদান নেই।
যে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লোকপ্রশাসন বিষয়টি পড়ানো হয়, সেগুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
এছাড়াও আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটিকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের উচ্চ পর্যায়ের বিভাগ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় জনপ্রশাসনে স্নাতক (বিপিএ) এবং স্নাতক প্রোগ্রাম (এমপিএ) উভয়ই শুরু করেছে। এছাড়াও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (এমপিপিজি) এবং এমএইচডি-তে এমএ করার সুযোগ দিচ্ছে।
কী পড়ানো হয়
বিভিন্ন সাবজেক্টের সমষ্টি নিয়ে লোকপ্রশাসনের সিলেবাস হওয়ায় সিলেবাসটা মোটেও বোরিং বা একঘেয়ে না। এটি মূলত প্র্যাক্টিক্যাল একটা সাবজেক্ট। আর কোর্সভুক্ত টপিকগুলোও অনেক ইন্টারেস্টিং আর সময়োপযোগী।
লোকপ্রশাসন বিভাগের একজন শিক্ষার্থীকে অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়। এছাড়াও ম্যানেজমেন্ট, তথ্য প্রযুক্তি, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ল, একাউন্টিং, এনজিও অ্যান্ড ভলান্টিয়ারিজম, এনথ্রোপলজি, ফিন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশের প্রশাসন ও রাজনীতির ইতিহাস,স্থানীয় সরকার, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয় যা একজন দক্ষ প্রশাসক হতে সাহায্য করে।
লোকপ্রশাসন পড়ে উচ্চশিক্ষার ও গবেষণার সুযোগ
লোকপ্রশাসন থেকে উচ্চশিক্ষার দুয়ার খোলা আছে সবসময়। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য ফান্ড পাওয়া যায়। তবে মাস্টার্স এর চেয়ে পিএইচডিএর জন্য ফান্ড পাওয়া তুলনামূলক সহজ এবং এধরনের ফান্ডিং পেতে শিক্ষার্থীর ভালো যোগ্যতাও আবশ্যক হয়ে থাকে।
সরাসরি পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন ছাড়াও বর্তমানে এর সম্প্রসারিত কিছু বিষয় যেমন Development Administration, Governance, Public Relation ইত্যাদি বেশ কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স ও পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন সময়ে ফুল ফ্রি স্কলারশিপ এর সুযোগ প্রদান করা হয় মাস্টার্স ও পিএইচডি সম্পন্ন করার জন্য। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও মাস্টার্স, পিএইচডি ও এমফিল করার সুযোগ তো থাকছেই।
চাকরির সুযোগ
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে প্রশাসন। সুতরাং, লোকপ্রশাসনের পরিসর অত্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়গুলোর মধ্যে লোকপ্রশাসন বিষয়ের নামে একটি মন্ত্রনালয় আছে এবং সেই জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে (Ministry of Public Administration) লোকপ্রশাসন পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে লোভনীয় পদে চাকরির সুযোগ।
এছাড়া বিশেষ সুযোগ রয়েছে সরকারি কর্ম কমিশনে। বিসিএসে যতগুলো ক্যাডার রয়েছে, এর মধ্যে প্রশাসন, পুলিশ, সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে চাকরি পান এ বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। এ ছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ইত্যাদি বিভাগে তাঁরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, মানবাধিকার সংস্থা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, ব্যাংক, বিমা ও বিভিন্ন এনজিওতে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভালো বেতনে কাজ করছেন। অনেকে আবার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় চাকরি করছেন।
দেশের বাইরে যেমন যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে এ বিভাগের ডিগ্রিধারীরা এখন ভালো বেতনে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
Leave a Reply