জীবন মুখি জাপান

জীবন মুখি জাপান

সেঞ্চুরি পার করাটা জাপানিদের মধ্যে তেমন কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু কেন? প্রথম সূর্যোদয়ের সেই দেশে কী রহস্য লুকানো রয়েছে? আসলে কোনও ম্যাজিকও নয়। স্রেফ লাইফ স্টাইলেই বাজিমাৎ করেছেন জাপানিরা। জীবনযাত্রায় কোন জিনিসগুলো মেনে চললে জাপানিদের মতো দীর্ঘ আয়ু পেতে পারেন আপনিও। বিস্তারিত জানাচ্ছেন: শামস্ বিশ্বাস

খাদ্যাভ্যাস আর জীবনধারার ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে নিহত হয় ২.৫ মিলিয়ন থেকে ৩.১ মিলিয়ন মানুষ। এতো বড় একটি বিপর্যয়ের পরেও জাপানের মানুষ তাদের কঠিন অধ্যাবসায় ও সঠিক নিয়মের চর্চার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় এ দেশটি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গড় আয়ু সম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছে এবং বেশ লম্বা সময় ধরেই প্রথম স্থানটি এ দেশটির দখলে রয়েছে।

জাপানের প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের বয়স ৯০ বছরের উপরে। যার প্রায় ৭০ হাজারের বয়স ১০০ বছরেরও বেশি। জাপানের গড় আয়ু ৮৪.২ বছর। গড় পুরুষেরা ৮১.১ বছর বাঁচে। নারীদের গড় আয়ু আরও বেশি ৮৭.১ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী জাপানের লোকেরা ৭৫ বছর পর্যন্ত কোন ধরনের দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই বেঁচে থাকেন। জাপানীদের এই দীর্ঘ আয়ু তাদের জেনেটিক গঠনের ফলাফল নয়। বরং, এটি খাদ্যাভ্যাস আর জীবনধারার ফলাফল।

 

খাবারে পর্যাপ্ত সবজি

অন্যান্য যেকোন দেশের মতো বিভিন্ন ধরনের খাবার নয়, জাপানের খাদ্য তালিকায় বড় একটা অংশ জুড়েই থাকে তাজা শাক-সবজি, মৌসুমি ফলমূল, ফার্মেন্টেড সয়া ও  ভাত। যা থেকে পর্যাপ্ত ফাইটোকেমিক্যালস, ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার এই নিয়ম খুব সহজেই দীর্ঘায়ু পেতে অবদান রাখে।

 

সামুদ্রিক খাবার

এখানে সামুদ্রিক খাবার খুবই প্রিয় এবং মাংসের চাহিদা বেশ কম। প্রকৃতপক্ষে, জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মাছ খাওয়া জাতিগুলোর একটি। মাছে কোলেস্টেরল এবং ক্ষতিকারক চর্বির পরিমাণ খুবই কম। ফলে, জাপানে  হৃদরোগের ঝুঁকি ৩৬ শতাংশ কম। জাপানিরা প্রচুর সয়া এবং সমুদ্র-শৈবাল খায়৷ এক কাপ সমুদ্র-শৈবালে ২-৯ গ্রাম প্রোটিন থাকে। এটিতে প্রাকৃতিক আয়োডিন থাকে, যা থাইরয়েডের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

 

ব্যতিক্রম রান্নার ধরণ

জাপানের মানুষেরা প্রায়  ঘরোয়া খাবার খায়। ফলে, জাপানে স্থূলতার হার মাত্র ৩.৬ শতাংশ, যা পৃথিবীতে সর্বনিম্ন। সাধারণত জাপানিজদের খাবার তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে স্টিমিং (ভাপে রান্না), ফার্মেন্টিং (গাঁজন), স্লো-কুকিং, প্যান গ্রিলিং ও স্টির ফ্রাইং। রান্নার এই ধরণগুলোতে প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদানের পুষ্টিগুণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অক্ষুণ্ণ থাকে। ফলে যা খাবার খাওয়া হয়, তা থেকে প্রায় সবটুকুই উপকারিতা শরীর পায়।

 

চা পানের সংস্কৃতি

জাপানে দীর্ঘ জীবনের আরেকটি কারণ, অধিক পরিমাণ চা গ্রহণ। জাপানে বহু প্রজাতির চা পানের সংস্কৃতি বহু পুরনো। অন্যান্য দেশে যেখানে কফি পানকে আভিজাত্য হিসেবে দেখা হয়, জাপানে চা পানের সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা হয়ে অভিজাত্যের সাথে। কফিতেও রয়েছে বহু স্বাস্থ্য উপকারিতা, তবে জাপানে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রজাতির চা তথা মাচা চা থেকে পাওয়া যাবে আরও অনেক বেশি উপকারিতা। চা’য়ে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ কফির চেয়ে অনেক বেশি। চা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, প্রতিরোধ করে ক্যান্সার, ধ্বংস করে কোলেস্টেরল।

 

ফ্রেশ খাবার

আমরা দৈনিক যে খাবারগুলো খাই, তার কতটা ফ্রেশ হয় ভাবুন তো একবার। এদিক থেকে জাপানের মানুষেরা খুব কড়া নিয়ম মেনে চলে। তাদের প্রতিটি খাবার একদম ফ্রেশ উপাদানে তৈরি হওয়া চায়। এমনকি বাজারজাত খাবার তৈরি হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা খাবার খেয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী খাবার তৈরি করা হয়। ফলে বাড়তি খাবার থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই ফ্রেশ খাবার শরীরে বাড়তি শক্তি জোগাতে কাজ করে।

 

তুলনামূলক ছোট পাত্র

খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখা জাপানি সংস্কৃতির অনেক বড় একটি অংশ। তারা ছোট পাত্রে চপস্টিক ব্যবহারের মাধ্যমে খাবার খায় এবং পাত্রে খাবারও নেয় পরিমাণে কম। এছাড়া জাপানিরা একদম পেট ভরে খাবার না খেয়ে, পেটের কিছু অংশ খালি রেখে দেয়। এতে করে খাবার পরিপূর্ণভাবে হজম হয়।

 

বেশি শারীরিক কার্যক্রম

জাপানিরা কর্মময় জীবন অতিবাহিত করে। বেশিরভাগ জাপানিরা নিকটতম বাসস্টেশনে হেঁটে যায়, এরপর ট্রেনে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করে এবং ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যায়। এরা প্রায়ই অফিসে যায় হেঁটে বা সাইকেলে। প্রতিদিন সকালে এই নিয়ম মেনে চলার ফলে সকালের শরীরচর্চার অনেকখানি পূরণ হয়ে যায় এবং প্রয়োজনীয় কর্মশক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া এতে করে শরীর ও মন চাঙা হয়ে ওঠে, ফলে কর্মশক্তি ফিরে পাওয়া যায়। বয়স্করাও যতদিন সম্ভব শারীরিক পরিশ্রম অব্যাহত রাখে।

 

ঘুমানোর আগে গোসল

প্রায় ৮৫ ভাগ জাপানি ঘুমানোর আগে গোসল করে। গোসলে গরম পানির ব্যবহার  ঘামের দূষণ থেকে রক্ষা করে। পানির উষ্ণতা শরীরের প্রদাহ কমায় এবং মানসিক চাপ কমায়। গরম পানি রক্ত সঞ্চালন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

 

নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপ

জাপানের চিকিৎসা ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকরী। রাষ্ট্র চিকিৎসার ৯০ ভাগ পর্যন্ত ব্যয় বহন করে।  জাপানের নাগরিকেরা নিয়মিত ডাক্তারের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। এ নিয়মে কোন হেরফের হয় না। ফলে সামান্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলেও, তা দ্রুত সমাধান করে ফেলা হয়। এতে করে বড় ধরনের কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয় না।

 

বয়স্কদের মানসিকভাবে উজ্জীবিত করা

জাপানিদের দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকতে সহায়তা করে বৃদ্ধদের মানসিক চাপ কম থাকা। দেখা গেছে জাপানি বুড়ো-বুড়িরা তাদের সন্তানদের কল্যাণে বৃদ্ধ বয়সে মানসিক শান্তিতে থাকেন। তাদের সাধারণত আয়-ব্যয়, বিভিন্ন বিল ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। জাপানিরা ঐতিহ্যগতভাবেই বয়স্কদের যথেষ্ট যত্ন নেয়। আর বয়স্করাও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে অভ্যস্ত। জাপানে বয়স্ক মানুষদের জীবন্ত সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সামাজিকভাবে দেয়া হয় সর্বোচ্চ সম্মান। যা বয়স্কদের রাখে মানসিকভাবে উজ্জীবিত।

 

জীবনের লক্ষ্য

বিজ্ঞানীদের মতে, সুন্দর এ পৃথিবীতে মানুষ যদি তার লক্ষ্য ঠিক করতে পারে, তাহলে সে আরো কয়েক বছর বেশি বাঁচবে । সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন মানুষের তুলনায় জীবনে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে এমন মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। গবেষক দলের প্রধান কানাডার কার্লেটন ইউনিভার্সিটির ডক্টর প্যাট্রিক হিল বলেন, জীবনে নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া ও আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা সম্ভব।

গবেষকরা জানিয়েছেন, তাদের গবেষণার ফল অনুসারে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমে প্রবীণ বয়সেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া সম্ভব। যে কোনো বয়সেই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে জীবন-আয়ুতে যোগ করে নেয়া সম্ভব আরো কয়েকটি বছর। তবে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে দীর্ঘায়ুর ব্যাপারটি ঠিক কী কারণে জড়িত, সে বিষয় সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি গবেষকরা।

 

দীর্ষআয়ুদের এলাকা ওকিনাওয়া

জাপানের ওকিনাওয়া অঞ্চলেও দীর্ঘজীবী মানুষের ছড়াছড়ি। এ অঞ্চলে মানুষ কারাতে অনুশীলন করে, প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করে এবং আধ্যাতিক নানা বিষয় চর্চা করে। বংশানুক্রমে তারা নানা স্বাস্থ্যকর বিষয় শিশুদের শেখায়।

ওকিনাওয়ায় মানুষের দীর্ঘ জীবনের কারণ অনুসন্ধানে তাদের জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করেছেন বেশ কিছু বিদেশি। এতে অঞ্চলের মানুষের ভিন্ন ধরনের খাবার ও জীবনযাপনের নমুনা পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে রয়েছে ভাত ও টফু (সয়াবিনের একটি খাবার)। এ ছাড়া বাঁশের কচি ডগার তরকারি, সামুদ্রিক লতা-পাতার তরকারি, আচার, শুকরের ভুঁড়ির অংশবিশেষ এবং ছোট কেক থাকে তাদের খাবারের তালিকায়। এ অঞ্চলের মানুষের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের হারও খুবই কম। প্রতি সপ্তাহে তিনটি সার্ভিস-এ মাছ খায় এ অঞ্চলের মানুষরা। তাদের খাদ্যতালিকায় থাকে দানাদার শস্যের খাবার, সবজি ও সয়াবিনের বিভিন্ন পণ্য। এ ছাড়া তারা অক্টোপাস ও স্কুইডের খাবার খায় এবং টউরিন পান করে।

 

 

 

 

 


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *