নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। সপ্তদশ শতক থেকে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভার পদগুলো পূরণ করা হতে পারে, কখনো আবার কার্যনির্বাহী ও বিচারব্যবস্থা ছাড়াও আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি বাছাইও নির্বাচনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া আবার প্রয়োগ হয় বহু বেসরকারি সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও। ক্লাব বা সমিতি থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও করপোরেশন বা নিগমেও এই প্রক্রিয়ার ব্যবহার করা হয়। নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সব আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই কোনো এক ধরনের নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ধরন ছিল প্রায় অভিন্ন। নির্বাচন ছিল প্রাচীন গ্রিক শাসনপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এবং সেখানে সাধারণত লটারির মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন হতো। আমেরিকার আদিবাসীদের অনেক গোত্রের লোকরা নির্দিষ্ট কোনো পাত্রে শস্যকণা নিক্ষেপের মাধ্যমে গোত্রপ্রধান নির্বাচন করত। প্রাচীন ভারতে কখনো কখনো স্থানীয় প্রধান নির্বাচিত হতেন। মুঘল শাসন বিধানে স্থানীয় জনগণের মনোনীত ব্যক্তিরা স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন। সম্রাট জেলা পর্যায়ে ফৌজদার ও অপরাপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতেন এবং অন্য কর্মকর্তারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন।
বৈদিক যুগে ভারতীয় সমাজে গোষ্ঠীর মধ্য থেকে ‘গণ’ নামক সংগঠনের ভোটে রাজা নির্বাচিত হতেন। রাজা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় (ক্ষত্রিয় হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের চতুর্বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণ। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত অনুসারে ক্রিয়ের উৎপত্তি স্রষ্টার বাহু থেকে। রাজ্যশাসন, রাজ্যরা এবং জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা তাদের দায়িত্ব।) শ্রেণির এবং পূর্বের রাজার পুত্রসন্তান হতেন। তবে এসব নির্বাচনে ‘গণ’-এর সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। মধ্যযুগে গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এক শতাব্দী ধরে চলা ‘মাৎস্যন্যায়’ অবসনের জন্য বাংলার সামন্তপ্রধানরা গোপাল নামে এক জনপ্রিয় সামন্ত নেতাকে বাংলার রাজপদে নির্বাচিত করেন। তিনি বাংলার পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ৭৫০ থেকে ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের চোলা সাম্রাজ্যের উঠিরামেরুরে (বর্তমানে তামিলনাড়ু) পাম গাছের পাতায় ভোটদানের মাধ্যমে গ্রাম পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করা হতো। মাটির তৈরি একটি পাত্রে প্রার্থীদের নাম লেখা পামপাতাগুলো রাখা হতো। কুডাভোলা নামক এ ব্যবস্থায় একজন বালককে গ্রাম পরিষদের যতজন সদস্য ততটি পাতা তুলতে বলার মধ্য দিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করা হতো।
আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে গঠিত রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের ফলে ঐতিহ্যগত নির্বাচন পদ্ধতির রূপান্তর ঘটেছে। নির্বাচন এখন গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সূচিত হয়। এর পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন নির্বাচনী আইনের (যেমন ১৬৯৪ সালের ট্রিনিয়্যাল অ্যাক্ট এবং ১৭১৬ সালের সেপ্টেনিয়্যাল অ্যাক্ট) মাধ্যমে এর নিয়মিতকরণ সম্পন্ন হয় এবং উনিশ শতকে পরপর প্রণীত সংস্কার বিলগুলোর আওতায় ভোটাধিকারের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। ১৮৭২ সালে গোপন ব্যালট পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং অবশেষে ১৯২৮ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান চালু হয়।
ভোট দেয়ার বয়স
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিংশ শতাব্দীতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ন্যূনতম বয়স ছিল ১৮ বছর। ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন নাগরিকরা উপলব্ধি করে যে একজন নাগরিক যে বয়সে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে, সেই বয়সটিই তার ভোট দেওয়ার জন্য যোগ্য। ফলে সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ২১ থেকে কমিয়ে ভোট দেওয়ার বয়স ১৮ করা হয়।
নারী ভোটাধিকার
১৮৯৩ সালে সর্বপ্রথম নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখায় নিউজিল্যান্ড। রাশিয়া ১৯১৭, ইংল্যান্ড ও জার্মানি ১৯১৮, মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র ১৯২০ এবং ফ্রান্স ১৯৪৪ সালে নারী ভোটাধিকার স্বীকৃতি দেয়। উল্লেখ্য, সুইজারল্যান্ড ১৯৭০ ও কুয়েত ১৯৯০ সালে নারী ভোটাধিকার স্বীকৃতি দেয়। বর্তমান সময়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান কেন্দ্র ভ্যাটিকান সিটিই হলো একমাত্র দেশ, যেখানে নারী ভোটাধিকার নিষিদ্ধ।
বাংলায় নির্বাচন
সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলায় গ্রামের লোকরা নিজ নিজ গ্রামের মোকদ্দম বা গ্রামপ্রধান, পাটোয়ারী বা কর আদায়কারী নির্বাচন করতেন। গ্রাম মোকদ্দমদের পরামর্শক্রমে পরগণা কাজী ও থানাদার নিযুক্ত হতেন। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত প্রচলিত গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনধর্মী বৈশিষ্ট্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়। কিন্তু উনিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পঞ্চায়েত প্রথা বহাল ছিল।
১৮৬৮ সালে পৌর আইন (৬ নম্বর আইন) প্রণয়নের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ মনোনীত সদস্য সমন্বয়ে পাশ্চাত্য ধরনের পৌর কমিটি গঠনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। শুধু পৌর করদাতাদেরই সদস্য নির্বাচিত করার অধিকার ছিল। ১৮৮৪ সালে প্রবর্তিত ৩ নম্বর আইন বলে ঢাকাসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভাগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। পৌর ও গ্রাম এলাকায় এই সীমিত নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর পর থেকেই গ্রামপর্যায়ে ভোটাধিকার সম্প্রসারণের নতুন পর্বের সূচনা হয়।
১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় আইনসভায় নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ভোটাধিকার ও নির্বাচনী সংস্থাকে সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯০৯ সাল থেকে সম্প্রদায় ও পেশার ভিত্তিতে নির্বাচন শুরু হয়। ১৯২০ সাল থেকে অনিয়মিতভাবে হলেও পৃথক নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয়, পৌরসভা ও জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তখনো সর্বজনীন না হলেও সেখানে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক আইন পরিষদে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার ভিত্তিতে এটাই ছিল সর্বশেষ নির্বাচন।
আধুনিক নির্বাচনব্যবস্থার সূচনালগ্ন থেকেই বাঙালিদের মধ্যে নির্বাচনে উৎসাহ তৈরি হয়। ঢাকা পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনের বিধান প্রবর্তিত হয়। ভোটাধিকার সম্প্রসারণের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল জনগণের দাবির ফল। কিন্তু প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থায় জনগণের আগ্রহ সত্ত্বেও পাশ্চাত্য ধাঁচের নির্বাচন বাংলায় কখনো সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর হয়নি। ১৯৩৫ সাল অবধি পৌরসভা, স্থানীয় পর্যায়ের কমিটি ও বোর্ডে নির্বাচিত ও মনোনীত উভয় ক্ষেত্রেই জমিদারদের প্রাধান্য ছিল। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও তাদের প্রভাব বজায় ছিল।
এর পর নির্বাচনের ইতিহাসে রাজনৈতিক মেরুকরণের ধারা লক্ষ করা যায়। ১৯২০ সাল পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন ছাড়াই প্রার্থীরা ব্যক্তিগত ও স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। এমনকি ১৯৩৭ সালের নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। পরবর্তী দশকে অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরঙ্কুশভাবে পরাজিত করে। এভাবেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। পরবর্তী সব নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাফল্য ছিল একান্তই ব্যতিক্রম।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর হিন্দুদের ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ, জমিদারি প্রথার বিলোপ এবং ১৯৫৬ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান প্রবর্তনের ফলে বিভাগপূর্ব নির্বাচন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ ও জেলা বোর্ড নির্বাচনে তুলনামূলকভাবে নবীন ও অনাবাসিক আইনজীবীরা প্রাধান্য বিস্তার করে। ষাট ও সত্তরের দশকে এ প্রক্রিয়ার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে এবং তখন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে পেশাদার রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে। আইয়ুবের দমনমূলক শাসন (১৯৫৮-১৯৬৯), স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন (১৯৬৬-১৯৭১), মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক পরিবর্তন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড এবং তৎপরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বৈরশাসন নির্বাচনের ধারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। তখন থেকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য নয়, বরং নির্বাচনকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আইনসিদ্ধ ও বৈধকরণের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়। ১৯৭৫-পরবর্তী দশকগুলোয় অনুষ্ঠিত এ ধরনের বেশ কিছু সাধারণ নির্বাচন বর্জন কিংবা প্রতিরোধের মুখে বাতিল হয়ে যায়।
১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন গণ-আন্দোলনের ফসল। বাংলাদেশের যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে অনুষ্ঠিত নির্বাচন তিনটি স্বাভাবিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
Leave a Reply