কেমব্রিজ এনালিটিকা, ফেসবুক

কলঙ্কিত ফেসবুক

হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মার্ক জাকারবার্গ তার রুমমেড ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিত্‌স এবং ক্রিস হিউজেসের যৌথ প্রচেষ্টায় হার্ভার্ডের ডরমেটরিতে ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এই সোশাল নেটওয়ার্কএর নামছিল ‘দ্য ফেসবুক ডটকম’। পরে ন্যাপস্টার প্রতিষ্ঠাতা শন পার্কারের পরামর্শে ফেসবুক থেকে ‘দ্য’ বাদ দিয়ে শুধু ফেসবুক করা হয়। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জানাশোনাকে বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক প্রদত্ত বইয়ের নাম থেকে এই ওয়েবসাইটটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ফেসবুক’।

ওয়েবসাইটটির সদস্য প্রাথমিকভাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সেটা বোস্টন শহরের অন্যান্য কলেজ, আইভি লীগ এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। আরো পরে এটা সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাই স্কুল এবং ১৩ বছর বা ততোধিক বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই সোশাল নেটওয়ার্কের মালিক হলো ফেসবুক ইনক। সারা বিশ্বে বর্তমানে মাসে ২.১৩ বিলিয়ন একটিভ ইউজার ফেসবুক ব্যবহার করছে।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ এই চলের পথে ফেসবুককে পোহাতে হয়েছে বেশকিছু সমালোচনা। কলঙ্কিত হতে হয়েছে নানান কেলেঙ্কারিতে। সাম্প্রতিক ফাঁস হওয়া কেমব্রিজ এনালিটিকা বিতর্কের পরে গ্রাহকদের তথ্য ফাঁস করার অভিযোগে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে ফেসবুক। মার্ক জাকারবার্গ প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়লেও মুখোমুখি হতে হচ্ছে মামলা, তদন্ত এবং সশিরি হাজিরা দেয়ার সামান। আওয়াজ উঠেছে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার। এরই মধ্যে অনেকেই ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। টুইটারে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে ‘ডিলিট ফেসবুক’ কর্মসূচি। যার ফলে শুরু হয়েছে #ডিলিটফেসবুক প্রচার। যেখানে বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যাক্তিতা তাদের ফেসবুক আইডি এবং পেইজ ডিলিট করে দিচ্ছে্।

 

ক্যামব্রিজ এনালিটিকা

ফেসবুক ব্যবহারকারীদেরকে না জানিয়েই ৫ কোটি গ্রাহকের তথ্য নিজেদের বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করেছিলো রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ এনালিটিকা। এই প্রতিষ্ঠানটি ডেটা মাইনিং এবং বিশ্লেষণের কাজ করে। এই কোম্পানি রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচন কৌশল তৈরি করতে সাহায্য করে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ডিজিটাল প্রচারণা চালানোর সুবিধার জন্যই নাকি এমনটি করা হয়েছিলো। ফেসবুক ব্যবহারকারী ও তাঁদের বন্ধুদের তথ্যভান্ডারে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল ক্যামব্রিজ এনালিটিকা। ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে গবেষণার নামে তারা এসব তথ্যের নাগাল পায়। তারা দাবি করেছিল, এসব তথ্য শুধু গবেষণার কাজে লাগানো হবে। এতে মানুষের নাম, অবস্থান, লিঙ্গ, তাদের পছন্দ-অপছন্দের তথ্য ছিল।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোগান একটি ফেসবুক ভিত্তিক ব্যক্তিত্ব প্রেডিক্টর অ্যাপ তৈরি করেন। ‘দিস ইস ইওর ডিজিটাল লাইফ’ এই অ্যাপ প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার লোক ডাউনলোড করে। এই অ্যাপ্লিকেশন মাধ্যমে মানুষের তথ্য চুরি করা হয়েছে। সেই ইউজারদের ফ্রেন্ডলিস্টের তথ্যও চুরি করা হয়েছে। ফেসবুকের সেই সময়কার নীতি অনুযায়ী, অ্যাপটির মাধ্যমে ঐ ২ লক্ষ ২০ হাজার জনের বন্ধুদেরও বিস্তারিত তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার হাতে চলে এসেছিল৷ সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য পেয়েছিল ঐ গবেষণা সংস্থাটি৷ পরবর্তীতে এই তথ্য সংস্থাটির সেই সময়কার ক্লায়েন্ট ও বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে৷ ঐসব তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন তৈরি এবং ভোটারদের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী তাঁদের কাছে নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়৷ নৈতিকতার কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্পের লাভ করাতে এবং নির্বাচন প্রভাবিত করতে ফেসবুকে উপভোক্তাদের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। যার মাধ্যমে ফ্লোটিং ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়েছিল। শুধু মার্কিন মুল্লুক নয়, একাধিক দেশে ভোটকে প্রভাবিত করতে কাজ করেছে ক্যামব্রিজ এনালিটিকা।

ক্যামব্রিজ এনালিটিকা কেলেংকারির ফাস হলে জানা যায় তাদের কার্যক্রম ছিল ভারতেও। প্রচেষ্ঠা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তা সম্প্রাসারণ করার। কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা’‌-‌র মূল কোম্পানি এসসিএল (‌স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন ল্যাবরেটরিজ)‌ যার সঙ্গে ভারতীয় কোনও সংস্থার সরাসরি যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের ওয়েবসাইটে একটি সংস্থার নাম মিলেছে-ওভলেনো বিজনেস ইন্টেলিজেন্স (ওবিআই)। যারা নিজেদের লন্ডনের এসসিএল সংস্থার সঙ্গে যৌথ অংশীদারিতে এসসিএল ইন্ডিয়া বলে পরিচয় দেয়। রাজনৈতিক প্রচার উপদেষ্টা সংস্থা হিসাবে ওবিআই-এর গ্রাহকদের তালিকায় বিজেপি, কংগ্রেস, জনতা দল ইউনাইটেড, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক, এয়ারটেলের নাম রয়েছে।

ফেসবুকের তথ্য পাচার, ঘুষ দেওয়া, রাজনীতিকদের ফাঁদে ফেলতে যৌনকর্মীদের কাজে লাগানোসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে, তাদেরই ২০১৯-এর ভোটপ্রচারের দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে সাপে-‌নেউলে ঝগড়া শুরু হয়েছে ভারতের রাজনীতিবিদদরে মধ্যে।

 

আত্মসাতের অভিযোগ

ফেসবুক ওয়েবসাইট কে আইন জটিলতায় পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকবার  মার্ক জুকেরবার্গের সহপাঠী কর্তৃক, তারা অভিযোগ এনেছেন যে ফেসবুক তাদের সোর্স কোড এবং অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে।

 

ফেকনিউজ

ভুয়া খবর বা বানোয়াট সংবাদ কিংবা গুজব প্রচার এবং তা থেকে সৃষ্ট সহিংসতা বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের জন্য মারাত্মক ফল বয়ে আনে। বিশ্বজুড়ে নানা ঘটনায় এটি স্পষ্ট যে ফেসবুকে মিথ্যা সংবাদ প্রচারের কারণে মানবগোষ্ঠীর গুরুতর ক্ষতি হতে পারে, মানুষের জীবন পড়তে পারে হুমকির মুখে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভুয়া খবর ছড়ানো ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়া ও রাশিয়ার কাছে বিজ্ঞাপন বিক্রি সম্পর্কিত বিষয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া খবর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচিত হতে সহায়তা করে। এই কঠোর সমালোচনা বন্ধ করতে এবং ভুয়া খবর বিতর্ক থেকে নিজেদের স্বচ্ছ অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করছে ফেসবুক। এর পরেও, ভুয়া খবর ঠেকাতে এবং এ প্ল্যাটফর্মটিকে বাজে কাজে লাগাতে যারা চেষ্টা করে তাদের ঠেকাতে ফেসবুক র্কৃপক্ষ এখনও তেমন পদক্ষেপ দেখাতে পারেনি।

 

মামলা মোকাদ্দমা

ফেসবুকে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তাও একটি সমস্যা হয়ে দেখা দেয় এবং তার নিরাপত্তাও বিভিন্ন সময় আপোষ-মীমাংসা হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে পড়তে হয় মামলায়।

 

সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ:

ফেসবুক অনেক দেশেই বারেবারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বন্ধ করা হয়েছে যার মধ্যে আছে চীন, ইরান, উজবেকিস্থান, পাকিস্তান, সিরিয়া, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং উত্তর কোরিয়া। উদাহরণসরূপ এটি পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্মীয় বৈষম্য ও বিদ্বেষী কর্মের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিরাপত্তা জনিত কারণেও বিভিন্ন দেশে সময়িক ভাবে একাথধিকবার ফেসবুক বন্ধ হয়েছে।

 

ব্যবহারে বাধা

‘সময় অপচয়’ ব্যাখ্যা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফেসবুক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অনেক জায়গায় কর্মীদের কাজের সময় ফেসবুক ব্যবহারের উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বছর দশের আগে ২০০৭ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ৪৩ শতাংশ ব্রিটিশ অফিস কর্মী কর্মক্ষেত্রে ফেসবুক ব্যবহার থেকে বিরত রাখা হয়। কারণ হিসাবে দেখানো হয়, কর্মীদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং ব্যবসায়িক গোপনীয়তা ফাঁস।

 

ষড়যন্ত্র

২০১১ সালের মে মাসে সাংবাদিক এবং ব্লগারদের কাছে ইমেইল পাঠানো হয় গুগলের গোপনীয়তার নীতির অভিযোগ নিয়ে। যদিও শেষে দেখা যায় যে, গুগল প্রতিরোধকল্পে পিআর খ্যাত বারসন-মারসটেলার এটি করে এবং অর্থদাতা ছিল ফেসবুক যা সিএনএন সহ বেশ কিছু গণমাধ্যমে সমালোচিত হয়।

 

ইভেন্টে মাত্রাতিরিক্ত ভিড়

২০১১ সালে জার্মানির কর্তৃপক্ষ ফেসবুকের ইভেন্ট বৈশিষ্ট্যটি বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা করে। এই সিদ্ধান্তের জন্য অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যাতে আসলে দাওয়াত না দেয়া ষত্বেও মানুষ চলে এসেছে ইভেন্টে এমন ঘটনা দায়ী। একটি ঘটনায় দেখা যায় প্রায় ১,৬০০ অতিথি একটি হামবার্গে মেয়ের ১৬তম জন্মদিনে উপস্থিত হয়েছেন কারণ মেয়েটি তার জন্মদিনের ইভেন্টটিকে ফেসবুকে অসাবধানতা বশত পাবলিক করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় একশরও বেশি পুলিশকে নামাতে হয়েছিল ভিড় সামলাতে। এতে একজন পুলিশ অফিসার আহত এবং ১১ অংশগ্রহণকারী আটক করা হয়েছিল বিভিন্ন কারণে। এমন অন্য একটি ঘটনায় দেখা যায়, ৪১ তরুণকে আটক করা হয়েছে এবং ১৬ জন আহত হয়েছেন।

 

একাউন্ট হ্যাক

২০১১ সালের নভেম্বরে, ভারতের ব্যাঙ্গালোরের অনেকগুলো ফেসবুক ব্যবহারকারী জানায় যে তাদের একাউন্ট হ্যাক করা হয়েছে এবং তাদের প্রোফাইল ছবি অশ্লীল ছবি দিয়ে রিপ্লেস করা হয়েছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিড অশ্লীল, হিংস্র ও যৌনতা ভিত্তিক বিষয়বস্তু দ্বারা স্প্যামে ভর্তি হয়ে যায়। এবং প্রতিবেদনে বলা হয় ২ লক্ষর বেশি একাউন্ট এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেসবুক এই প্রতিবেদনকে অসত্য বলে বর্ণনা করে এবং ব্যাঙ্গালোরের পুলিশ বিষয়টি পরিদর্শন করে মন্তব্য করেন – যে হয়ত এটি ফেসবুকের প্রতিযোগীদের কোন গুজব হতে পারে।

 

ডেটা হাতিয়ে নেয়া

নিজেদের মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারীদের জন্য নতুন এক তারবিহীন-নেটওয়ার্কিং অ্যাপ এনেছে ফেসবুক। কিন্তু নতুন অ্যাপটি যে তাদের মালিকানাধীন সে তথ্য শুরুতে জানায়নি। এ অ্যাপটি সোস্যাল জায়ান্টটির জন্য তথ্য সংগ্রহ করছে। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন ব্যবহারকারীদের পরিচয় গোপন আর অন্যান্য নিরাপত্তা ফিচার সুরতি রাখে। ব্যবহারকারীদের আরো নিরাপদ উপায়ে অনলাইন ব্রাউজ করার সুযোগ করে দেয় এটি। ‘ওনাভো প্রটেক্ট’ নামের এই অ্যাপটিও ব্যবহারকারীদের ভিপিএন সেবা দিয়ে থাকে। তবে অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের ডেটা পর্যবেণ করে ও তা ফেসবুক আর অন্যদের সাথে শেয়ার করে। এই শেয়ার করা তথ্যের মধ্যে ব্যবহারকারীর ডিভাইসে ইনস্টল করা অ্যাপ, ওই অ্যাপগুলো কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, ডিভাইস থেকে কোন কোন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা হচ্ছে আর কী পরিমাণ ডেটা ব্যবহার করা হচ্ছে এ বিষয়গুলোও রয়েছে বলে অ্যাপটির প্রাইভেসি নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়। এর মাধ্যমে কোনো ব্যবহারকারী ফেসবুকের কোনো সাইটে না থাকলেও, তিনি অনলাইনে কী করছেন তা জানতে এ ডেটা ব্যবহার করতে পারে ফেসবুক। সেইসাথে স্ন্যাপ আর টুইটারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর বানানো অ্যাপগুলো কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সে তথ্যও চলে যায় ফেসবুকের হাতে।

 

গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী, বিনিয়োগ গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং জনহিতৈষী জর্জ সরোস ফেসবুককে প্রযুক্তি ক্ষেত্রের একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।

সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সতর্ক করে তিনি বলে, এগুলো নতুন উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য হুমকি হিসেবে কাজ করে। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান মানুষের চিন্তা-ভাবনার পরিসর ঠিক করে দিচ্ছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই বিলিয়নিয়ার। ফলে মানুষ মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারছে না। যা ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের হুমকি।

এ সম্পর্কে জর্জ সরোস বলেন, মানুষের চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করছে একেবারেই অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। উদ্বেগের বিষয় হলো, এগুলোর পরিমাণ দিনে দিনে আরও কমছে। এ সময় তিনি ফেসবুকের সাথে সাথে গুগলের নাম বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেন এবং একই ধরণের সমালোচনায় সমালোচিত করেণ।

 

সরকারের সমালোচনা মুছে দেয়া

 

বিভিন্ন দেশের সরকারের চাপে ফেসবুক সাইট থেকে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা বা বিতর্কিত স্ট্যাটাস মুছে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে সামাজিক মাধ্যমটির বিরুদ্ধে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দাবি দাওয়া আদায়ে আন্দোলনরত কর্মীরা তাদের পোস্ট মুছে দেয়ার অভিযোগ করেছেন ফেসবুকের বিরুদ্ধে। সম্প্রতিক রুমানিয়ায় দুর্নীতি বিরোধী সমাবেশের আগে আন্দোলনকর্মীরা ফেসবুক থেকে তাদের পোস্ট মুছে দেয়ার অভিযোগ মুছে দেয়ার অভিযোগ করলেন। এর আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার প্রতিবাদে দেয়া বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট ডিলিট করে দেয়ার অভিযোগ করেছিলেন আন্দোলন কর্মীরা।

 

২০১১ সালে আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে প্রধান কারণ ফেসবুক!

 

ফেসবুক ইর্ষা

সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে ফেসবুকের কারণে আত্ম-সম্মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যা ইর্ষার জন্ম দেয় যেমন অবকাশ এবং ছুটির দিনের ছবি কথা। অন্যান্য ইর্ষার কারণগুলোর মধ্যে আছে বন্ধু বান্ধবের পারিবারিক সুখী এবং কারো দৈহিক সোন্দর্যের ছবি। এধরনের ইর্ষান্বিত অনুভূতি মানুষকে তাদের জীবনে একা এবং অতৃপ্ত করে দেয়। জার্মান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষনায় দেখা গেছে ৩ জনের মধ্যে একজন ফেসবুক চালানোর পর নিজেদের জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট। এবং অন্য একটি গবেষনা যা উটাহ ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়েছিল, উঠে আসে যে, ফেসবুকে সময় কাটানোর বাড়ানোর পর তারা তাদের জীবন সম্পর্কে নিকৃষ্ট অনুভূতি হয়েছিল।

 

আনফ্রেন্ড করার মানসিক প্রভাব

মনোবিজ্ঞানি সুজান ক্রাস হুইটব্রানের মতে – সাধারণত ফেসবুকে ভারচুয়াল ফ্রেন্ড করা হয়। তবু্ও সেখানে কাউকে আনফ্রেন্ড করা বা ফিরিয়ে দেয়ার খারাপ প্রভাব রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন আনফ্রেন্ড করা লোকটি ফেসবুকের বিচ্ছেদের শিকার। অন্য দিকে আনফ্রেন্ড করে দেওয়া কদাচিৎ পাস্পরিক সিদ্ধান্তে হয় এবং প্রায়শই দেখা যায় যাকে আনফ্রেন্ড করা হয়েছে তিনি তা জানেন না।

 

ফেসবুক আসক্তি

ফেসবুক আসক্তি কোকেন আসক্তির মতো বিপদজনক হতে পারে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এ গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে তারা দেখেন, কোকেনে আসক্তি যেরকম ভয়াবহ কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক আসক্তিও সেরকম। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি সাইকোলজিক্যাল রিপোর্টস: ডিজেবিলিটি অ্যান্ড ট্রমা নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়।

 

এই গবেষণায় মূলত ব্যবহারকারীদের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব কতটুকু বা কীভাবে প্রভাব ফেলে তা দেখার চেষ্টা করা হয়। গবেষকরা বিভিন্ন বয়সী ব্যবহারকারীদের ওপর এসব প্রভাব দেখতে চেষ্টা করেন। আর সেখানেই ফেসবুক আসক্তির এই বিষয়টি উঠে আসে।

 

গবেষণা প্রতিবেদনে গবেষকরা উল্লেখ করেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উদ্ভব ব্যবহারকারীদেরকে বিশেষ করে অল্পবয়সী ব্যবহারকারীদেরকে সমাজ থেকে পৃথক করে দিচ্ছে। এ ছাড়াও তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি একা হয়ে যাচ্ছে। আর এই আসক্তি অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চেয়ে ফেসবুকের ক্ষেত্রে বেশি।

 

যারা ফেসবুক আসক্তিতে ভুগছেন তাদের পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সেলিং খুবই জরুরি বলে মনে করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

 

আসক্তির লক্ষণ

১. নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত শেয়ার

২. যখন-তখন কারণ ছাড়াই ফেসবুকে ঢোকা

৩. প্রোফাইলের ছবিটি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া

৪. ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিউজ ফিড পড়া এবং এগুলো নিয়ে সময় পার করা

৫. অনলাইনের জন্য বাস্তবের জীবনকে জলাঞ্জলি দেওয়া

৬. কাউকে বন্ধু করতে পাগলের মতো আচরণ করা

৭. ফোনের নোটিফিকেশন বা কোনো নোটিফিকেশনের চিহ্ন দেখলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠা

৮. কোথাও গেলে সঙ্গে সঙ্গে চেক ইন করার মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া

৯. প্রায়ই মানুষকে ট্যাগ করা

১০. কাজের সময় লুকিয়ে গোপনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করা

১১. কেউ যখন কোনো ফেসবুক পোস্টে কোনো মন্তব্য করে না তখন হতাশ হয়ে পড়া

১২. বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অপরিচিতদের তালিকায় যুক্ত করার প্রবণতা

১৩. একেবারে মাঝ রাতে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে ফেসবুক চেক করা

১৪. ফেসবুক ছাড়া জীবন অচল হয়ে পড়ছে এ রকম ভাবনা পেয়ে বসা

 

ফেসবুক আসক্তির ফলে যা ঘটে

১. আবেগ-অনুভূতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে

২. হতাশা ও দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে

৩. একাকী বোধ হয় ও নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে আসক্ত ব্যক্তি

৪. কাজের সময় ঠিকঠাক থাকে না, কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়

৫. সময় জ্ঞান লোপ পায়, অসৎ পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করে

৬. নিজেকে অন্যর সঙ্গে তুলনা করে ঈর্ষাবোধ হতে শুরু করে

৭. দায়-দায়িত্ব ভুলে মনোযোগ ডুবে থাকে ফেসবুকে

৮. সম্পর্ক নষ্ট হয়, ঘর ভেঙে যেতে পারে

 

শারীরিক সমস্যা

১. পিঠব্যথা ২. মাথাব্যথা ৩. স্পন্ডাইলিটিজ বা মেরুদণ্ডে সমস্যা ৪. ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে কারও ওজন বেড়ে যায় আবার কারও ওজন কমে যায় ৫. ইনসমনিয়া বা ঘুমের ব্যাঘাত ৬. চোখে দেখতে সমস্যা।

 

 

 

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *