সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টকে যে কোনো ব্যবসার মেরুদন্ড বলা হয়। ব্যবস্থাপনার এই বিশেষ শাখা ব্যবসার শুরু থেকে গ্রাহকের কাছে সেবা পৌঁছানো পর্যন্ত কাজ করে থাকে। এর মধ্যে খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। এতে প্রতিযোগিতার মাত্রা বেড়ে গেছে। আর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে গুণগত মান বজায় রেখে তুলনামূলক কম খরচে পণ্য বা সেবা গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোটা সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট পেশাজীবীর চাহিদা তৈরি হয়েছে। সে অনুযায়ী সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বা সরবরাহ শিকল ব্যবস্থাপনার ওপর তৈরি হয়েছে বিশাল কাজের সুযোগ।
সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট কী?
সাধারণভাবে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বলতে বোঝায় পণ্য সরবরাহকে। কোনো প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল কেনা থেকে শুরু করে পরিকল্পনা, পণ্যের উৎস, মজুতকরণ, প্রস্তুত ও বিপণন কার্যক্রম দক্ষতা দিয়ে সময়মতো ও কম খরচে সম্পন্ন করাই হলো সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বা সরবরাহ শিকল ব্যবস্থাপনা। সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের পারিভাষিক অর্থ হলো- একটি পণ্যের প্রাথমিক উৎস থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের কাছে সেটিকে পৌঁছে দেওয়াই সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট। তবে আধুনিককালে পণ্য শুধু সরবরাহ করলেই হবে না। পণ্যের মান এবং প্রতিশ্রুত সময় রক্ষা করা পণ্য সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এমনকি বিক্রয়-পরবর্তী সেবাও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের অন্তর্ভুক্ত।
সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের কাজ কী?
সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে একটি অন্তর্নিহিত বিষয়, যেখানে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক বিষয়াবলি ছাড়াও বৈশ্বিক বিষয়ে জানা জরুরি। আরও বিশদভাবে বললে- সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে পণ্য সংগ্রহের একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা, পণ্য ক্রয় বা সংগ্রহ, পণ্য সজ্জিতকরণ বা শ্রেণিবদ্ধকরণ, পণ্য স্থানান্তর, পণ্য মজুদকরণ, পণ্য সরবরাহ, পণ্য বিক্রয় এবং বিক্রয়োত্তর সেবা। একজন সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপককে পুরো প্রক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠানের সব শাখার জনবলের সঙ্গে যোগাযোগ বা সমন্বয় রেখে করতে হয়। নিজস্ব পণ্য ছাড়াও পণ্যের খুঁটিনাটি এবং এর ক্রমোন্নত উন্নতি সাধন, পাশাপাশি ক্রেতার হাতে আরও উন্নত পণ্য আরও কম দামে পৌঁছে দেওয়া দক্ষ সাপ্লাই চেইন জনবলের প্রধান কাজ।
পড়াশোনা
দক্ষ পেশাজীবী হতে চাইলে সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করতে হবে। এ জন্য জানতে হবে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো। সে অনুযায়ী অনুশীলন করতে হবে। এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সার্টিফিকেট কোর্স, ডিপ্লোমারও দরকার। কেননা আধুনিক বিশ্বের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়গুলো ভালোভাবে জানতে ওসব কোর্স বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সাপ্লাই চেইনে দক্ষ জনবল তৈরিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অনেক দেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। যুক্তরাজ্যের দি চার্টার্ড ইনস্টিটিউিট অব প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড সাপ্লাই (সিআইপিএস) ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লাই চেন এডুকেশন অ্যালায়েন্সের (আইএসসিইএ) সিএসসিএম (সার্টিফাইড সাপ্লাই চেন ম্যানেজার), দেশের মধ্যে মাইন্ড মেপারস, ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (বিআইএইচআরএম), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম) সাপ্লাই চেইনে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা করাচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এ বিষয়ে ট্রেনিং কোর্স করাচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাপ্লাই চেইনের ওপর বিভিন্ন মেয়াদের কোর্স ও সেমিনারের আয়োজন করে থাকে।
সাধারণত সাপ্লাই চেইনের ওপর যেসব বিষয় পড়ানো হয় সেগুলো হলো – ইফেকটিভ নেগোসিয়েশন ইন পারচেজিং অ্যান্ড সাপ্লাই, ডেভেলপিং কনট্রাক্ট পারচেজিং অ্যান্ড সাপ্লাই, মেজারিং পারচেজিং পারফরম্যান্স, ম্যানেজিং পারচেজিং অ্যান্ড সাপ্লাই, পারচেজিং কনটেন্ট, ম্যানেজমেন্ট ইন দ্য পারচেজিং ফাংশন, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন, ইমপ্রোভিং সাপ্লাই চেইন পারফরম্যান্স, অপারেশনস ম্যানেজমেন্ট ইন দ্য সাপ্লাই চেইন, স্টোর অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, দ্য মেশিনারি অব গভর্নমেন্ট, মার্কেটিং পারচেজ, কনট্রাক্ট ইন দ্য পাবলিক সেক্টর, সাসটেইনেবল প্রকিউরমেন্ট, লার্নিং অ্যান্ড ইনফুনসিং ইন পারচেজিং, স্ট্র্যাটেজিকস সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ইন প্র্যাকটিস, লিগ্যাল এসপেকটস ইন পারচেজিং অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন, অ্যাডভান্স প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যান্স ফর পারচেজারস, স্ট্র্যাটেজিস, পাবলিক সেক্টর স্টেকহোল্ডার অ্যান্ড গভর্নেন্স ইত্যাদি।
চাকরির সুযোগ
বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে দিন দিন। বাড়ছে বিশ্বমানের শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অসীম সম্ভাবনার দুয়ার খুলে এ দেশেও গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ প্রডাক্ট সেলের জন্য একটি আকর্ষণীয় দেশ যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। পাশাপাশি পরিবহনের মাধ্যমে স্থল ও জলপথে অনেক সহজে ক্রেতার কাছে পৌঁছানো যায় পণ্য। এমন পরিবেশে বিদেশি কোম্পানিগুলো যেমন এগিয়ে আসছে, তেমনি এদেশীয় কোম্পানিগুলোও আরও বেশি পরিমাণে নতুন নতুন পণ্য বা সেবা নিয়ে ক্রেতার সামনে হাজির হচ্ছে। ভীষণ সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে খাতটি। এসব খাতের জন্য তৈরি হচ্ছে বিপুল কর্মসংস্থান। সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট পেশাজীবীদের দেশে-বিদেশেও রয়েছে প্রচুর চাহিদা। বিশ্বায়নের যুগে এ পেশার প্রসার খুব দ্রুত বাড়ছে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের পেশাজীবীদের খোঁজ করছে। এ খাতের পেশাজীবীরা সাধারণ সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট অফিসার, লজিসটিক, প্রকিউরমেন্ট ও গ্রাহকসেবা ইত্যাদি পদে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তবে দেশে যে হারে শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ নিত্যনতুন উদ্ভাবন হচ্ছে, সে অনুপাতে নেই দক্ষ জনশক্তি। বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায়ও দক্ষ জনবল সংকট রয়েছে। এমন পরিবেশে এই সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়তে পারলে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
Leave a Reply