বাংলাদেশের জলবায়ু কবুতর পালনের জন্য অত্যান্ত উপযোগী। গ্রামে বা শহরে কবুতর পালন করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছে। বেকার সমস্যা সমাধানে কবুতর পালন অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখতে পারে।
কবুতরকে সহজে পোষ মানানো যায় বলে গ্রাম-গঞ্জ, এমনকি শহরের বাসা-বাড়িতে অনেকে কবুতর পালন করেন। বাড়ির যে কোনো স্থানে পালন করা যায় কবুতর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাঠের বাক্সে পুরনো পদ্ধতিতে কবুতর পালন করা যায়। তবে ইদানিং বাজারে বাচ্চা কবুতরের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নত পদ্ধতিতে কবুতর পালনের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কবুতরের মাংস খুবই সুস্বাদু এবং এতে প্রোটিনের পরিমাণ অন্য পাখির মাংসের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি। অনেকেই শখের বশে কবুতর পালন করে। আয়ের উৎস হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে কবুতর পালন খুবই লাভজনক। উন্নতজাতের প্রতি জোড়া কবুতর ২ হাজার থেকে প্রায় ১ লাখ টাকায়ও বিক্রি হয়।
কেন বাণিজ্যিকভাবে কবুতর পালন?
কবুতর সহজেই পোষ মানে এবং পালন খরচও অনেক কম। রোগ-ব্যাধিও তুলনামূলকভাবে খুবই কম হয়ে থাকে। একজোড়া কবুতর থেকে প্রতিমাসে গড়ে ২টি বাচ্চা পাওয়া যায় এবং চার সপ্তাহের মধ্যেই বাচ্চা খাওয়া বা বিক্রি করার উপযোগী হয়। মল জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অল্প জায়গাতেই পালন করা যায়। কবুতরের খাবারের খরচ কম এবং থাকার ঘর তৈরি করতে খরচ কম লাগে। মুক্তভাবে পালন করলে খাবার খরচ খুবই কম। কবুতরের মাংস সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণও অধিক এবং সহজপাচ্য। কবুতর পালন করে অল্প পুঁজি এবং পরিশ্রমে লাভবান হওয়া যায়।
বাজার সম্ভাবনা
কবুতরের মাংস খেলে শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং খেতেও খুব সুস্বাদু। এর বেশ বাজার চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া অনেকে শখের বশে বাড়িতে পালার জন্যও কবুতর ক্রয় করে।
প্রশিক্ষণ
ইন্টারনে, বই কিংবা অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে কবুতর পালনের বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। কবুতর পালন-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ইউনিয়ন পর্যায়ে পশু কর্মকর্তা অথবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্রে পশু পালনবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
পুঁজি
বাণিজ্যিকভাবে কবুতর পালনের জন্য খুব বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। তাই মোটামুটি অল্প পুঁজি দিয়ে এই ব্যবসায় নেমে পড়তে পারেন। বাণিজ্যিকভাবে কবুতর পালনে শুরুর জন্য পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার মূলধনের প্রয়োজন। যদি নিজের কাছে প্রয়োজনীয় পুঁজি না থাকে তবে পরিবারের কারো কাছে থেকে কিংবা আত্মীয় স্বজন, সরকারী বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া যেতে পারে।
কবুতরের জাত
পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ২০০-৩০০ জাতের কবুতর রয়েছে। মাংস উৎপাদনের জন্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হোয়াইট কিং, টেক্রেনা, সিলভার কিং, হামকাচ্চা, ডাউকা, কাউরা, গোলা, গোলী, পক্ক, লক্ষণ ইত্যাদি। সৌখিন লোকেরা খেলাধূলা বা আমোদ ফুর্তির জন্য ময়ূরপংখী, সিরাজী, লহোরী, ফ্যানটেইল, মুকি, জেকোভিন, গিরিবাজ, টেম্পলার, লোটন ইত্যাদি কবুতর পুষে থাকে। আমাদের দেশে জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য কবুতরের একটি জাত হচ্ছে ‘জালালী কবুতর’।
কবুতরের জীবনচক্র
পুরুষ ও স্ত্রী কবুতর জোড়া বেঁধে সাধারণত আজীবন একসাথে বাস করে। এদের জীবনকাল ১২ থেকে ১৫ বছর। ৫ থেকে ৬ মাস বয়সে স্ত্রী কবুতর ডিম পাড়া শুরু করে। ২৮ দিন পরপর ৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে দুইটি ডিম দেয় এবং পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত দেয়া ডিমে বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা সক্রিয় থাকে। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১৭ থেকে ১৮ দিন সময় লাগে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ই পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিমে তা দেয়ার ১৫-১৬ দিনের মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষ উভয় কবুতরেরই খাদ্য থলিতে দুধ জাতীয় বস্তু তৈরি হয় যা খেয়ে বাচ্চারা ৪দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ১০ দিন পর্যন্ত তারা বাচ্চাকে ঠোঁট দিয়ে খাওয়ায় এরপর বাচ্চারা দানাদার খাদ্য খেতে আরম্ভ করে।
কবুতরের বাসস্থান
কবুতর পালার জন্য নির্দিষ্ট কোন জায়গার প্রয়োজন নেই। বাড়ির আঙিনায়, বাসার ছাদ বা জানালার কার্নিশে কবুতর পালন করা যায়। হালকা কাঠ, পাতলা টিন, বাঁশ বা প্যাকিং কাঠ দিয়ে কবুতরের ঘর বানানো যায়। কবুতরের থাকার ঘরটি এমনভাবে উঁচু করে তৈরি করতে হবে, যেন ক্ষতিকর প্রাণী ও পাখিদের নাগালের বাইরে থাকে। কবুতরের ঘরে প্রচুর আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টির পানি যেন ঢুকতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। কবুতরের ঘর পাশাপাশি বা কয়েক তলাবিশিষ্ট হতে পারে। খাবার ও পানির পাত্র কবুতরের ঘরের সামনে রাখতে হবে। কবুতরের ঘর পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে। প্রতিমাসে একবার কিংবা দুবার করে ঘরের বিষ্ঠা পরিষ্কার করতে হবে।
খাদ্য
কবুতর সাধারণত বিভিন্ন প্রকার শস্যদানা যেমন-গম, মটর, খেসারি, সরিষা, ভুট্টা, কলাই, ধান, চাল,কাউন, জোয়ার ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এরা খোলা আকাশে উড়ে বেড়ায় এবং পছন্দমত স্থান থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগাড় করে থাকে। এছাড়া কবুতরের খাবারে ১৫-১৬ শতাংশ আমিষ থাকা প্রয়োজন। মুরগির জন্য তৈরি সুষম খাবার খাওয়ালে সুফল পাওয়া যায়। কবুতরের বাচ্চার দ্রুত বৃদ্ধি, হাড় শক্ত ও পুষ্টি এবং বয়স্ক কবুতরের সুস্বাস্থ্য ও ডিমের খোসা শক্ত হওয়ার জন্য ঝিনুকের খোসার গুঁড়া, চুনাপাথর, শক্ত কাঠ কয়লা গুঁড়া, হাড়ের গুঁড়া, লবণ এসব মিশিয়ে ‘গ্রিট মিকচার’ তৈরি করে খাওয়াতে হবে। প্রতিটি কবুতর প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৬০ গ্রাম দানাদার খাদ্য খেয়ে থাকে। এছাড়াও প্রতিদিন কিছু কিছু কাঁচা শাক-সবজি কবুতরকে খেতে দিলে ভাল হয়।
রোগ ও প্রতিকার
কবুতরের রোগ-ব্যাধি তুলনামূলক কম হয়। সচরাচর কবুতরের যে রোগগুলো হয়ে থাকে, তা হলো রাণীক্ষেত ও পক্স। এছাড়া পরজীবী দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য সময়মতো টিকা প্রদান করতে হবে এবং জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে। নিয়মিত সুষম খাদ্য দিলে এবং পর্যাপ্ত আলো, বাতাসের ব্যবস্থা থাকলে রোগ-ব্যাধি কম হয়ে থাকে।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রোগ ও প্রতিকার:
বসন্ত- ত্বকের পালকবিহীন জায়গায় ফোস্কা হয়, গলার ভেতর ছোট ক্ষত হয়। চার সপ্তাহ বয়সে বুকে বা পায়ে পিজিয়ন পকস টিকা দিতে হয়।
কলেরা- শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অরুচি, ওজন হ্রাস, শ্বাসকষ্ট, সবুজ ও হলুদ ডায়রিয়া। ট্যারামাইসিন ক্যাপসুল বা কসুমিকস প্লাস ওষুধ খাওয়াতে হবে।
রক্ত আমাশয়- দুর্বলতা, শীর্ণতা, ফ্যাকাশে ভাব, ক্ষুধামন্দা, রক্ত মিশ্রিত মলত্যাগ। ইএসবি-৩ বা এমবাজিন বা এলড্রন পানিতে মিশিয়ে তিন দিন খাওয়াতে হবে।
কৃমি- ক্ষুধা ও পিপাসা বৃদ্ধি, দুর্বলতা, রক্তস্বল্পতা, ডায়রিয়া, ওজন হ্রাস প্রভৃতি। এডিপার বা ইউভিলন কিংবা কুপেইন, মেবেন ট্যাবলেট প্রতি তিন মাস পরপর খাওয়াতে হবে।
আয়-রোজগার
সাধারণত, দশ জোড়া কবুতরের জন্য খাবারের পাত্র এবং পানির পাত্রসহ ঘর বানাতে আনুমানিক ১,২০০ থেকে ১,৫০০ টাকা খরচ হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জোড়া কবুতরের দাম আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। (প্রয়োজনমত যে কোন সময় ক্রয়মূল্যেই এসব কবুতর বিক্রয় করা যাবে।) ১০ জোড়া কবুতর থেকে প্রতি মাসে আট থেকে নয় জোড়া কবুতরের বাচ্চা পাওয়া যাবে। এগুলো বিক্রি করে গড়ে হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
Leave a Reply