সিমেন্ট শিল্প
সিমেন্ট
সিমেন্ট হল সেই সকল গুড়া জাতীয় পদার্থের সাধারণ নাম, যাদেরকে পানি বা অন্য কোন তরলের সাথে মিশ্রিত করলে কাদার মত নমনীয় পদার্থ পাওয়া যায় এবং তা কিছু সময়ের মধ্যে জমে গিয়ে বিভিন্ন দৃঢ়তার শক্ত পদার্থ গঠন করে। সিমেন্ট বাড়ী-ঘর, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি যাবতীয় নির্মাণ কাজের প্রধান উপাদান। অনেক ধরনের সিমেন্ট হয়ে থাকে। যেমন: পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট, পজুলানা সিমেন্ট, অধিক অ্যালুমিনা সমৃদ্ধ সিমেন্ট, ক্ষয়রোধী সিমেন্ট, পানিরোধী সিমেন্ট, রঙ্গিন সিমেন্ট ইত্যাদি। সিমেন্টের মূল উপাদানগুলি হল – চুন জাতীয় পদার্থ।(চক্, চুনাপাথর ইত্যাদি) এবং মাটি জাতীয় পদার্থ।(সিলিকা, আয়রন অক্সাইড, এ্যালুমিনা ইত্যাদি)।দীর্ঘকাল ধরেই নির্মাণ কাজে ইটপাথর বা অন্যান্য বস্তু দিয়ে গাঁথার কাজে সিমেন্ট সংযোজক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রচলিত সিমেন্টের মধ্যে পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট বহুল ব্যবহৃত যা চুন ও কাদার মিশ্রণ পুড়িয়ে পাউডারের মতো চূর্ণ করে তৈরি করা হয়। বালি ও পানির সাথে সিমেন্ট মিশিয়ে ‘মর্টার’ এবং ইট বা পাথরের টুকরা, সিমেন্ট, বালি ও পানি মিশিয়ে কংক্রিট তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশের সিমেন্ট
বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প অনেক পুরাতন হলেও সম্প্রতি এ শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। সরকার এ খাত থেকে প্রতি অর্থ বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৩০টি বেসরকারি সিমেন্ট কারখানা উৎপাদন কার্যক্রমে রয়েছে। সম্মিলিতভাবে এসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় তিন কোটি টন। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে বছরে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টন সিমেন্ট। তবে ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটানোর জন্য বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা পর্যাপ্ত নয়। বিষয়টি মাথায় রেখে বেশকিছু সিমেন্ট কোম্পানির উদ্যোক্তা উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম শুরু করেছেন। এরই মধ্যে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন কেউ কেউ। স্বাধীনতার পর দেশের সিমেন্ট উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো তিন লাখ টনের মতো, চাহিদা ছিলো প্রায় সাত লাখ টন। চার থেকে পাঁচ লাখ টন আমদানি হতো। ২০১০ সালে দেশের সিমেন্টের বছরে প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়, যা দেশেই উৎপাদিত হয়। সিমেন্ট উৎপাদনে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এখন সিমেন্ট রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা বছরে গড়ে পাঁচ শতাংশ করে বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু সিমেন্ট চাহিদা বিশ্বের সর্বনিম্ন। মাথাপিছু মাত্র ৫০ কেজি। ইইউতে ২০০ কেজি, যুক্তরাষ্ট্রে ৫০০ কেজি, ভারতে ১০০ কেজি। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে সিমেন্ট ব্যবহার কম। সিমেন্ট তৈরির প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানও অপর্যাপ্ত। এদেশে গৃহনির্মাণসহ অন্যান্য নির্মাণকাজের প্রধান উপাদান নির্বাচন এমনভাবে করা হয় যাতে সিমেন্টের ব্যবহার সামান্যই হয়। গ্রামাঞ্চলে মানুষ ঘরবাড়ি তৈরির জন্য সচরাচর পাটখড়ি, বাঁশ এবং মাটি প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে। কেবল আর্থিক বিবেচনাই নয় বরং অপেক্ষাকৃত সহজ প্রযুক্তি ও আরামদায়ক গৃহনির্মাণের তাগিদ থেকেও উপর্যুক্ত উপাদান নির্বাচন করা হয়। যারা ইট, সিমেন্ট দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ঘরবাড়ি তৈরি করতে আগ্রহী তাদের অনেকে এর ব্যয়ভার বহনে অপারগ। এসব বিষয়ের মিলিত প্রভাব সিমেন্টের চাহিদাকে সীমিত করে রেখেছে। তবে, সাম্প্রতিককালে পূর্বতন ধারার ভবনগুলির পরিবর্তে আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণের যে প্রবণতা সূচিত হয়েছে তাতে সিমেন্টের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু যেহেতু দেশের অর্থনীতি এখনও কৃষিনির্ভর, শিল্প ও নির্মাণ খাতে এখনও দ্রুত পরিবর্তন আসেনি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন কেবল কিছু নির্বাচিত খাতেই আবর্তিত হচ্ছে বিধায় সিমেন্টের চাহিদা এখনও অনুল্লেখযোগ্যই থেকে যাচ্ছে। আশির দশকের মধ্য থেকে কিছু বৃহদাকৃতির অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হওয়া ও বর্ধিত নগরায়ণ, শহরাঞ্চলে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং ও বহুতল দোকানপাট নির্মাণ কাজ সম্প্রসারণ এবং গ্রামের সচ্ছলদের আধুনিক বাড়িঘরের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় সিমেন্টের চাহিদা তুলনামূলকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সিমেন্ট উৎপাদন এবং আমদানি উভয় কর্মকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
স্থানীয় কাঁচামাল এবং আমদানিকৃত ক্লিনকার উভয় উপাদান থেকেই স্থানীয়ভাবে সিমেন্ট তৈরি হয়। দেশীয় কোম্পানিগুলি চীন, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে ক্লিনকার আমদানি করে। স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে সিমেন্ট উৎপাদনের বিষয়টি স্থানীয় উৎসের ওপর নির্ভরশীল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, জয়পুরহাট ও সিলেট অঞ্চলে চুনাপাথরের খনি রয়েছে। ছাতক ও আয়েনপুর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি (সিলেট অঞ্চলে) স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চুনাপাথর থেকে সিমেন্ট উৎপাদন করে। এ দুটি সিমেন্ট কারখানার মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় তিন মিলিয়ন টন। কারখানা দুটি সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে।
সিমেন্ট কোম্পানি
বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সরকারি সিমেন্ট কারখানা ছাতক। যা একসময়ের সর্ববৃহৎ সিমেন্ট কারখানা ছিল। গুনে-মানে ছিল বেসরকারি যে সিমেন্টের অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বর্তমানে দেশে সিমেন্টের ৮০ শতাংশ দেশী প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে। দেশী কারখানাগুলোর মধ্যে আবুল খায়ের গ্রুপের শাহ্ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, আকিজ গ্রুপের আকিজ সিমেন্ট, বসুন্ধরা গ্রুপের ‘মেঘনা সিমেন্ট মিলস ইউনিট ১ ও ২ এর বসুন্ধরা সিমেন্ট এবং কিংব্রান্ড সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস্ এর প্রিমিয়ার সিমেন্ট, মেঘনা গ্রুপের ইউনিক সিমেন্ট মিলস্ এর ফ্রেশ ও মেঘনাসেম, মদিনা গ্রুপের টাইগার সিমেন্ট, থ্রি রিংকস্ ও বাফেলো হেড সিমেন্ট, এম. আই. সিমেন্টের ক্রাউন সিমেন্ট, মেট্রোসেম সিমেন্ট মিলস্ এর মেট্রোসেম সিমেন্ট, ইস্টার্ন সিমেন্ট মিলস্ এর এর সেভেন হর্স সিমেন্ট, কনফিডেন্স সিমেন্ট, আরামিট সিমেন্ট, আনোয়ার গ্রুপের আনোয়ার সিমেন্ট, রয়েল সিমেন্ট, মীর আখতার হুসেন লিমিটেড এর মীর সিমেন্ট। আছে গাজী গ্রুপের গাজী সিমেন্ট, নিটল-নিলয় গ্রুপের নিটল সিমেন্ট, দেশবন্ধু গ্রুপের দেশবন্ধু সিমেন্ট, ইস্টার্ন সিমেন্ট, সেনা কল্যাণ সংস্থার এলিফেন্ট ব্রান্ড সিমেন্ট । দেশের আরো উল্লেখযোগ্য সিমেন্ট কোম্পানি হল: আহাদ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লি, আলহাজ্ব মোস্তফাহাকিম সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লি., বি.ই.ই.সি ইন্টারপ্রাইজ লি. বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লি., বসুন্ধরা ট্রেডিং কোং লি., বেঙ্গল টাইগার সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লি., বিশ্বাস কনস্যুলেন্ট, সিমেক্স সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লি., চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার গ্রিংডিং কোং, লি., কনফিডেন্স সিমেন্ট লি., ডায়মন্ড সিমেন্ট লি., ইস্টার্ন সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লি., জিবিবি ট্রেডিং (প্রা.) লি., হোন্ডাই সিমেন্ট (বা.) কোং লি., ইন্টারন্যাশনাল সিমেন্ট লি., মডার্ন র্স্ট্যাক্চারাল সার্ভিস লি., মঙ্গলা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ঢাকা, ন্যাশনাল সিমেন্ট মিলস্ লি., প্যাসিফিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ (বিডি) লি., পান্থ সিমেন্ট পেপার বাঘ, এস. আলম সিমেন্ট, ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লি.। বিদেশী কিছু প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্পে বিনিয়োগ করেছে। তার মধ্যে হোলসিম বাংলাদেশ লিঃ এর হোলসিম সিমেন্ট, হাইড্রেলবার্গ বাংলাদেশ লিঃ এর স্ক্যান সিমেন্ট এবং রুবি সিমেন্ট, সিমেক্স সিমেন্টের ব্যান্ড সিমেক্স, এমিরেটস্ সিমেন্ট মিলস্ ভারতী আদিত্য বিড়লার সাথে উৎপাদন করছে আল্ট্রাটেক সিমেন্ট, সুন সাং সিমেন্ট সেভেন সার্কেল বাংলাদেশ লিঃ তৈরি করছে সেভেন রিংকস্ সিমেন্ট। মিসেন্টঅন্যদিকে ফরাসি-স্প্যানিস যৌথ বিনিয়োগে সুরমা নদীর তীরে লাফার্জ-সুরমা তৈরি করছে সুপারক্রিট সিমেন্ট ও পাওয়ারক্রিট সিমেন্ট। লাফার্জ-সুরমা সিমেন্ট দীর্ঘ ১৭ কিলোমিটার কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে সরাসরি ভারতের মেঘালয় থেকে কাঁচামাল আনছে যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তঃসিমান্ত কনভেয়ার বেল্ট হিসেবে স্বীকৃত। তাই নয় এই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দেশের সিমেন্ট চাহিদার ১০ ভাগের একভাগ পূরণ করে। ভারতে সিমেন্ট রপ্তানি করে বাংলাদেশ তার মধ্যে ক্রাউন সিমেন্ট একাই রপ্তানি করে ৪০ ভাগ। তাছাড়া শাহ্, প্রিমিয়ার, আকিজ, সেভেন রিংকস্, আরামিট, কনফিডেন্স ও বাংলাদেশে উৎপাদিত আল্ট্রাটেকও আছে।
সম্ভাবনা
প্রতি বছর জাতীয় আয়ের হিসাবে নির্মাণ শিল্পের অবদান ১০ ভাগের উপরে। নির্মাণ শিল্পের অন্যতম প্রধান সহযোগী হচ্ছে সিমেন্ট এ শিল্প। গত এক দশকে সিমেন্ট শিল্পে আশাতীত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই বিপ্লবে প্রধান কারিগর। আরও সুখবর হলো বাংলাদেশের সিমেন্ট এখন মানের ক্ষেত্রে বিদেশী সিমেন্টের সাথে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা রাখে। বিশ্বের বাজারও খোলা রয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সরকারী নীতি ও সহযোগিতা। বাংলাদেশে সিমেন্টের দাম বিশ্ব বাজারের চেয়ে অনেক কম। এমন কি ভারত পাকিস্তানের চেয়েও দাম কম। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যাগ সিমেন্টের দাম ১০ থেকে ১২ ডলার। দুবাইতে ৮ ডলার, ভারত-পাকিস্তানে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ডলার। বাংলাদেশে পৌনে চার ডলার। প্রতি ব্যাগে সরকারী রাজস্ব রয়েছে প্রায় এক ডলার। বাংলাদেশ, দুবাই, আফগানিস্তান ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সিমেন্ট রফতানি করতে পারে। শুধু প্রয়োজন সরকারী সহযোগিতা। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনশক্তির অধিকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সস্তা শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে শিল্পায়ন কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। কার্বন নির্গমন প্রতিরোধ সম্পর্কিত কিওটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করায় ইতিমধ্যে চীনসহ অনেক দেশ শ্রমঘন শিল্প-কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর শুরু করেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট শিল্প-কারখানার প্রসার ঘটানো সম্ভব। এর ফলে সিমেন্ট উৎপাদন শিল্পে বাংলাদেশ এশিয়ার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
প্রতিবন্ধকতা
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানাবিধ কারণে দেশের অর্থনীতিতে চলছে চরম মন্দা। এর প্রভাবে দেশের সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল নির্মাণ শিল্প খাতে চলছে অবিশ্বাস্য স্থবিরতা। ফলে সম্ভাবনাময় সিমেন্ট শিল্প খাতেও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এ খাতের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।সিমেন্ট শিল্পের আরেকটি সব সমস্যা হল, এ শিল্পে বিনিয়োগ নীতি ও তথ্য সুস্পষ্ট না থাকায় দেশের উত্তরাঞ্চলে বহু ছোট ছোট সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। যার প্রায় সবগুলোই বর্তমানে বন্ধ। আর এতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা গিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ সজাগ থাকলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। ছোট মিলগুলো চালু থাকলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। কারণ তাদের উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। কারো ক্ষমতাই মাসে তিন হাজার টনের বেশি নয়। প্রতিটি বড় মিলের উৎপাদন ক্ষমতা মাসে ৫০ হাজার টন থেকে একলাখ টন। অসম প্রতিযোগিতায় ছোট মিলগুলো কখনও টিকতে পারবে না।
এই খাতের সংশ্লিষ্টদের মতে, সম্পূর্ণ বিদেশী কাঁচামাল নির্ভর সিমেন্ট একটি পুঁজিঘন শিল্প। বিশ্ববাজারে প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে দেশী কারখানাগুলোয়ও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিনিয়োগ করতে হয়; কিন্তু উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়ায় বেশির ভাগ কারখানায়ই নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে ছোট কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে বড় কোম্পানিগুলো ছোটগুলোকে কিনে নিচ্ছে নামমাত্র মূল্যে এমন কথাও শোনা গেছে।
আবার চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়ে অনেক উৎপাদনকারীর পক্ষে সিমেন্টের মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সিমেন্টের প্রধান উপাদান কিংকারের পরিমাণ কমিয়ে কস ফার্নেয়স স্লেট, লাইমস্টোন ও ফাই অ্যাশের ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে অনেক কোম্পানি। এতে উৎপাদিত পণ্যের মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এসব সিমেন্ট দিয়ে নির্মিত স্থাপনার স্থায়িত্ব নিয়েও। জানা যায়, প্রতি টন কিংকারের দাম বর্তমানে ৫০ থেকে ৫২ ডলার। অন্য দিকে ফাই অ্যাশের দাম মাত্র ৮ থেকে ১০ ডলার। বিএসটিআইর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ ফাই অ্যাশ ব্যবহারের অনুমোদন থাকলেও এতদিন প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকতে অনেকে ফাই অ্যাশ, লাইমস্টোন, ফার্নেস স্লেট প্রভৃতি কম দিয়ে অধিক পরিমাণে কিংকার ব্যবহার করতেন। কিন্তু আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে বর্তমানে কিংকারের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় পতিত হয়েছে দেশের বর্তমান সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো। ফলে, সিমেন্ট বাজারে নিম্নমানের সিমেন্টে সয়লাব হয়ে গেছে। এতে দেশের নির্মাণ শিল্প এখন ঝুঁকির মুখে।
বেসরকারি পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ ডেভেলপার কোম্পানি অধিক মুনাফার লোভে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহার করছে নিম্নমানের সামগ্রী। সরকারি কাজেও চলছে একই অবস্থা। মানসম্পন্ন দেখিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের এসব সামগ্রী। নিয়মিত মনিটরিং না থাকার সুযোগে এই তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক ডেভেলপার কোম্পানি ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। অবকাঠামো নির্মাণে লক্সিঘত হচ্ছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)। এ অবস্থায় ক্রমেই দেশের বিভিন্ন স্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সামান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে পুরো দেশ। এমনকি, ব্যক্তিমালিকানা বাড়ি নির্মাণেও ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের সামগ্রী। দক্ষ স্থপতি ও প্রকৌশলীর সহায়তা না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি নিচ্ছে বাড়ি নির্মাতারা। ভূতত্ত্ববিদ ও আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে যেভাবে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে করে ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চল ধ্বংসস্তপে পরিণত হতে রিখটার স্কেলে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পের প্রয়োজন হবে না। সাড়ে ৬ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পই এর জন্য যথেষ্ট।
ইমারত শিল্পের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে মনিটরিং জোরদার করা ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই। আর সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোকে রক্ষা করতে হলে দরকার সরকারি উদ্যোগ। একমাত্র সরকারি উদ্যোগের ফলে দেশের এই সম্ভাবনাময় সিমেন্ট শিল্প আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ বিদেশ থেকে কিংকার আমদানি শুল্ক কমানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ এই শিল্পকে প্রসার ঘটাতে সাহায্য করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
Leave a Reply