‘গোস্টরাইটা’র মানে কিন্তু ভূতলেখক নয়। ভৌতিক উপন্যাস বা ভূতের গল্পের লেখকও নয়। গোস্টরাইটার (Ghostwriter)হলো এমন একজন লেখক, যিনি অন্যের হয়ে লেখেন। লেখালেখির ভূতলেখকরা এক ধরনের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা। বিশ্বখ্যাত বেশ কিছু ধ্রুপদী সাহিত্য যেমন হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড, অডিসি বা শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটসহ বেশ কিছু নাটক ও সনেট নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে। অন্যদিকে আবার অনেক কিংবদন্তি জীবনের শুরুতে তারা অন্যের হয়ে লিখেছেন। গোস্টরাইটার নিয়ে যত মজার তথ্য আছে তা সাজিয়ে আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন শামস্ বিশ্বাস
আদি গোস্টরাইটার
পৃথিবীর প্রায় সাহিত্যে আদিকাল থেকে কমবেশি বিরাজ করছে গোস্টরাইটার। কবে এবং কীভাবে গোস্টরাইটাররা লিখতে শুরু করল কিংবা কেই বা আদি ভূতলেখক, যাকে পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করে উত্তরসূরিরা পথ চলতে শুরু করল বলা মুশকিল কিংবা কে গোস্টরাইটারের জনক তা অজানা। আদিকাল গোস্টরাইটারদের নিয়ে নানা গুজব প্রচারিত আছে।
গোস্টরাইটাররা পারিশ্রমিকের বিনিময়েই কিন্তু অন্যের জন্য বই লেখা। এ কাজে সৃজনশীল, মননশীল ও আত্মজীবনীমূলক বই যেমন থাকে, গবেষণাপত্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তৃতা, এমনকি ছাত্রছাত্রীদের টার্ম পেপারও বাদ যায় না। মূলত রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনীতিক, সিনেমা তারকা, খেলোয়াড়দের আত্মজীবনী ও স্মৃতিচারণামূলক বই লিখতে গোস্টরাইটাররা ভাড়া খাটেন। এমনও শোনা যায়, অনেক প্রকাশনা সংস্থা তাদের বাজারচলতি বই ছাপতেও গোস্টরাইটারদের ভাড়া করে থাকে। বিশেষ করে, থ্রিলার বা রহস্যকাহিনীর ক্ষেত্রে এটা বেশ কাজে লাগে বলে শোনা যায়।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ভূতলেখক
হিস্ট্রি ডটকম ও দ্য গার্ডিয়ানে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে নিয়ে বলা হয়েছে, মার্ক টোয়েন, হেনরি জেমস, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, হেলেন কেলার, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা সন্দেহ করে হেনরি দ্য ফিফথ, জুলিয়াস সিজার, অ্যাজ ইউ লাইক ইট, ব্যাক টু ব্যাক ও হ্যামলেট-শেক্সপিয়ারের কিনা। তাদের মতে, এই লেখাগুলোর সাহায্যকারী হিসেবে ছিলেন ফ্রান্সিস বেকন আর নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো।
ভূতলেখক লেখা আত্মজীবনীমূলক বই
স্বাধীনতা-উত্তরকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আত্মজীবনীমূলক বই ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ ‘আসলে কে লিখে দিয়েছিলেন’ তা নিয়ে নানা গুজব একসময় বেশ প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশেরও একজন সাবেক সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতির ‘কবিতা লেখা’ নিয়ে এমন গুঞ্জন ছিল। বেনজির ভুট্টোর আত্মজীবনীমূলক বই ‘ডটারস অব ইস্ট’ লেখার জন্যও গোস্টরাইটার ছিলেন। বারাক ওবামার ‘চেঞ্জ উই ক্যান বিলিভ ইন’ (২০০৮), ‘ওডাসিটি’ (২০১৭) হোক কিংবা হিলারি ক্লিনটনের ‘স্ট্রংগার টুগেদার’ (২০১৬) হোক, এসব বই কিন্তু লিখে দিয়েছিলেন ভূতলেখকরাই। হিলারির বই নিয়ে একবার দারুণ সমালোচনা হয়েছিল। সাংবাদিকরা ফাঁস করে দিয়েছিলেন যে বই বাবদ হিলারি ক্লিনটন পাবেন ১৭ মিলিয়ন ডলার আর গোস্টরাইটার পাবেন ১৩ মিলিয়ন ডলার! এটা যে খুব উঁচুদরের পারিশ্রমিকের নমুনা তা বলাই বাহুল্য।
রোনাল্ড রিগ্যান, অ্যালেন গ্রিনস্পানসহ এখনকার ডোনাল্ট ট্রাম্প – এমন অনেকের নাম বলা যাবে, যাদের আত্মজীবনী লেখার পেছনে রয়েছেন একজন গোস্টরাইটার। পৃথিবীতে এমন অনেক বিখ্যাত মানুষ আছেন, আত্মজীবনী বা উপন্যাস লেখার কাজে যারা গোস্টরাইটারদের সাহায্য নেন। জন এফ কেনেডির বই লিখেছেন টেড সোরেনসেন, সারা পেলিনের জন্য লিখেছেন লিন ভিনসেন্ট, হিলারি ক্লিনটনের জন্য ম্যারিয়ান ভলার্স।
বিখ্যাত মার্কিন ফুটবলার জিপারকে (জর্জ গিপ) একজন সাংবাদিক তার আত্মজীবনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি এটি একটি দুর্দান্ত বই! আমি সময় পেলে এটা পড়তে চাই।’
গোস্টরাইটার দিয়ে লেখানো ‘ন্যান্সি ড্রিউ
গোস্টরাইটার দিয়ে লেখানো বিখ্যাত সিরিজ ‘ন্যান্সি ড্রিউ’। এই সিরিজটির গোড়াপত্তন করেছিলেন মার্কিন প্রকাশক-শিশুসাহিত্যিক এডওয়ার্ড স্ট্রেটমেয়ার। ১৯২৬ সালে ‘হার্ডিবয়েজ’ নামে একটি সিরিজ শুরু করেছিলেন স্ট্রেটমেয়ার। পরে মেয়েদের জন্যও একটা চরিত্র দাঁড় করানোর কথা মাথায় আসে তার। সেই থেকে ন্যান্সি ড্রিউয়ের শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় এই গোয়েন্দা সিরিজ ১৯৩০ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। ‘ন্যান্সি ড্রিউ’ সিরিজটির প্রতিটি বইয়ের লেখকের জায়গায় লেখা থাকে ক্যারোলিন কিনের নাম। কিন্তু আসলে এ নামে কোনো লেখকই নেই! ৭৩ বছর ধরে চলা এ সিরিজটি লিখছেন একাধিক লেখক, যাদের নাম কখনই প্রকাশ করা হয়নি।
জেমস বন্ড লিখেছে অন্য কেউ?
বন্ডফ্যানইভেন্টস ডটকম ওয়েবসাইটে জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিংকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। বলা হয়েছে, ইয়ান ফ্লেমিংয়ের বই দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান তার নিজের লেখা নয়। তিনি এর আউটলাইন করেছিলেন বটে, কিন্তু সে সময় বেশ অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল না। তখন তার প্রকাশক গোস্টরাইটার ভাড়া করেন এবং বইয়ের কাজ শেষ করেন। বই বের হওয়ার পর সবাই প্রশংসায় ভাসিয়ে দেয়। তবে এর মূল লেখক কে, তা অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
ভূতলেখক আছে ‘জ্যাক রায়ান’ লেখায়!
জ্যাক রায়ান চরিত্রটির স্রষ্টা বিখ্যাত এসপিওনাজ থ্রিলার লেখক টম ক্ল্যান্সি। ১৯৮৪ সালে স্নায়ুযুদ্ধের পটভূমিতে দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর উপন্যাসের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পাঠকদের তিনি পরিচয় করিয়ে দেন জ্যাক রায়ানের সঙ্গে। ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জ্যাক রায়ানকে নিয়ে রচনা করেন মোট ১৭টি উপন্যাস, যার অনেকগুলোই বেস্ট সেলার হয়। তিনিও সাহায্য নিতেন গোস্টরাইটারদের। তার মৃত্যুর পরও তার অতীতের সহলেখকরা সিরিজটিকে চালিয়ে নিয়ে যান।
বিখ্যাত সাহিত্যিকদের ভূতলেখক
এখানেই শেষ নয়, বলা হচ্ছে, আলেকজান্ডার দ্যুমার দ্য থ্রি মাসকেটিয়ার্স, মিশেল ক্রিস্টনের ল্যাটিচিউড, রবার্ট লুডলামের জেসন বোর্ন নিয়ে লেখা বোর্ন সিরিজে রয়েছে ‘ভূতের আসর’। এমনকি সাই-ফাইয়ের জনক জুলভার্নও নাকি গোস্টরাইটারদের সাহায্য নিতেন। এভি ক্লাব নামের একটি ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, প্রবল জনপ্রিয় লেখক আইজাক আসিমভও গোস্টরাইটারদের সাহায্য নিতেন! আসিমভের গোস্টরাইটারের নাম – উইলিয়াম এফ’য়ু। বর্তমানে জনপ্রিয় থ্রিলার ঔপন্যাসিক জেমস প্যাটারসন। তিনি নিজেই কবুল করেছেন, ভূতলেখকের একটি দল রয়েছে তার।
আলেকজান্ডার দ্যুমা ও তার ভূতলেখক
‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স,’ ‘ম্যান আন্ডার আয়রন মাস্ক’ প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থেও ফরাসি লেখক আলেকজান্ডার দ্যুমা শেষ বয়সে লিখতে পারতেন না। গোস্টরাইটারদের দিয়ে তিনি বই লেখাতেন। তিনি নিজেও সেই বই পড়ে দেখতেন না। দ্যুমার পুত্র আলেকজান্ডার দ্যুমা ফিলসও ছিলেন সাহিত্যিক। তিনিও পিতার মতো নাম করেছিলেন। বিখ্যাত এই পিতা-পুত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল এবং দুজনের মধ্যে কথা বলা বন্ধ ছিল। একদিন বাড়ির দোরগোড়ায় পিতা-পুত্রের দেখা। পিতা পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আমার সর্বশেষ বইটা পড়েছ তো?’ পুত্র উগ্র কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, ‘তুমি নিজে পড়েছ?’
গোস্টরাইটারদের পারিশ্রমিক
লেখার ক্ষমতা অনুযায়ী ভূতলেখকদের পারিশ্রমিকের তারতম্য রয়েছে। বিষয়টি নির্ভর করছে, যার নামে বইটা লেখা হচ্ছে, তার ব্র্যান্ড ভ্যালু। ইন্টারনেট সূত্রে জানা যায়, ১৫০ থেকে ২০০ পৃষ্ঠার একটা বইয়ের জন্য একজন প্রতিষ্ঠিত গোস্টরাইটার এ কাজের পারিশ্রমিক বাবদ ১৫ থেকে ২০ হাজার ডলার পেয়ে থাকেন। আমেরিকায় গোস্টরাইটার এত জনপ্রিয় যে, সেখানে অনেক জনপ্রিয় প্রকাশনী সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে ভূতলেখকদের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
Leave a Reply