ভেটেরিনারি ডাক্তারের কাজ পশুপাখির রোগের কারণ খুঁজে বের করা ও তাদের চিকিৎসা প্রদান করা । কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ভেটেরিনারি ডাক্তারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কাজের সুযোগ ও চাহিদা থাকার কারণে অনেকেই এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
ভেটেরিনারি ডাক্তার
দেশের আত্মসামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে ক্যারিয়ার গড়ার ভিন্ন ভিন্ন খাত তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রাণী সম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক জোর দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পরিবেশ বিপর্যয় ইত্যাদি নানা কারণে মানুষের মতো পশুপাখিরও বিভিন্ন রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে পশু-পাখিদের যারা রোগ নির্ণয় এবং নিরাময় করার জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভেটেরিনারি ডাক্তার, ভেটেরিনারিয়ান বা পশু-পাখির ডাক্তার প্রয়োজন। মূলত প্রাণী চিকিৎসকরাই ভেটেরিনারিয়ান বা ভেটেরিনারি ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। আমাদের দেশে গরু, মুরগি ইত্যাদির ফার্ম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ভেটেরিনারি ডাক্তারদের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কটি পেশায় দ্রুত সফলতা ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব তার মধ্যে অন্যতম হল পশু চিকিৎসকের পেশা।
কেন এই পেশা
মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রায় সাড়ে ৩শ বছর ধরে সারা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে ভেটেরিনারি শিক্ষাব্যবস্থা তথা ভেটেরিনারিয়ানরা। মানুষের প্রয়োজনে আবিষ্কৃত ঔষধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, রোগ প্রতিষেধক টিকা এবং প্রতিকারের উপায় বের করতে ভেটেরিনারিয়ানদের অবদান অনস্বীকার্য। পৃথিবীতে প্রাতিষ্ঠানিক ভেটেরিনারি শিক্ষার ইতিহাস বহু পুরোনো। প্রায় সাড়ে ৩শ বছর আগে ফ্রান্সের লিয়ন শহরে ১৭৬৬ সালে পৃথিবীর প্রথম ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে সারা বিশ্বের ভেটেরিনারিয়ানরা।
কৃষি প্রধান দেশগুলোতে পেশা হিসাবে পশু চিকিৎসকের পেশা বেছে নেয়া তা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও। আমাদের দেশে ব্যাতিক্রম। তবে সময়ের সাথে সাথে এই পরিবর্তন এসেছে। এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার পেছনে বেশ কিছু শক্ত কারণ আছে যা সাধারণত অনেকেরই অজানা। এর পেছরে মূলগুলো হল: প্রাণীজগতকে সাহায্য করা, বিভিন্ন পশুর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা বা চিকিৎসা করার সুযোগ, বিদেশি স্কলারশিপ, আকর্ষণীয় বেতন, সুস্থ সমাজ গড়ায় সহায়তা করা, নিজস্ব দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারা, স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ, চাকরির বাজারে শক্তিশালী অবস্থানসহ পশুপক্ষী ভালোবাসা এমন হৃদয়বানদের সাথে কাজ করা করার সুযোগ।
ক্যারিয়ার গ্রাফ
বাংলাদেশে দিনদিন ভেটেরিনারি ডাক্তারের কাজের ক্ষেত্র ও সুযোগ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিষয়ের ছাত্রদের ছাত্রত্বকালীন সময়ে যেমন আছে শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা, তেমনই আছে পড়াশোনার পাট চুকিয়েই কর্মজীবনে ঢোকার সুযোগ – ভালো আয়রোজগারের নিশ্চয়তা। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ভেটেরিনারি নিয়ে পড়াশোনা করে ব্যবহারিকভাবে যেমন ডাক্তারির সুযোগ রয়েছে, সেই সাথে মেডিসিনের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন এনজিও, ফার্ম বা অন্যান্য সংস্থায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে। পশুপক্ষীর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকলে ভেটেরিনারি ডাক্তার হিসাবে এই মহান পেশায় যোগদান করে প্রাণীসম্পদের সেবার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের জন্য অবদান রেখে ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।
পড়াশুনা
বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। ভেটেরিনারিতে ডিগ্রী প্রদান কারী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ: চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় (চট্টগ্রাম), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ময়মনসিংহ), শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিলেট), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (দিনাজপুর), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (গাজীপুর), পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পটুয়াখালী), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাজশাহী), ঝিনাইদহ ভেটেরিনারি কলেজ (ঝিনাইদহ) ।
ভর্তির যোগ্যতা ও সময়
অন্যান্য বিষয় গুলোর মত ভেটেরিনারিতেও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এ পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে একজন দক্ষ প্রাণী চিকিৎসক হিসেবে দেশের সেবা করার জন্য অবশ্যই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করতে হবে। সেই সাথে জীব বিজ্ঞান সাবজেক্ট থাকতে হবে। ভর্তি বিষয়ক যাবতীয় তথ্য উল্লেখিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
শিক্ষা পদ্ধতি
ভেটেরিনারিয়ান হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করতে হলে অবশ্যই ৪ বছর মেয়াদি ডিভিএম কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। সেই সাথে রয়েছে এক বছর মেয়াদি ইন্টার্নশিপ। সাধারণত এ বিষয়ে সেমিস্টার পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান হয়ে থাকে। একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার হতে হলে তাকে অধ্যয়ন করতে হয় : এনাটমি, হিস্টোলজি, অ্যানিম্যাল সায়েন্স, নিউট্রিশন, পোল্ট্রি সায়েন্স, ডেইরী সায়েন্স, ফিজিওলজি, বায়োক্যামিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি ও থেরাপিউটিক্স টক্সিকোলজি, প্যাথলজি, প্যারাসাইটোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ব্যাক্টেরিওলজি, ভাইরোলজি, সেরোলজি, এনিম্যাল জেনেটিক্স ও ব্রিডিং, মেডিসিন, সার্জারি, ভেটেরিনারি এপিডিমিওলজি, গাইনিকোলজি ও অবস্ট্রাট্রিক্স, থ্রেরিওজেনোলজি, রেডিওলোজী- ল্যামনেস এন্ড সাউন্ডন্যাস, অপারেটিভ সার্জারি, পরিসংখ্যান, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি, মার্কেটিং, কৃষি সম্প্রসারণ বিদ্যা, ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ প্রভৃতি বিষয়াদি।
উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ
ডিভিএম পাস করার পর একজন ভেটেরিনারিয়ান বাংলাদেশেই উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে পারে। দেশের যে কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মেসি, পাবলিক হেলথসহ সকল বিষয়ে এমএস ও পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে। সেই সাথে উন্নত বিশ্বের যে কোন দেশে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য পেশা হতে প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
কাজের সুযোগ
পশু প্রাণী চিকিৎসার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে যথাযথ ডিগ্রি অর্জনের পর বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ ও নিবন্ধন সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। একজন সাধারণ কৃষক বা খামারির জন্য পশুপালন, পুষ্টি এবং পশু চিকিৎসা একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। বিসিএসে ভেটেরিনারি ছাত্রদের জন্য রয়েছে বিশেষ কোটা। বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারলে সরকারিভাবে ভেটেরিনারি সার্জন এবং উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতে পারে। সেনাবাহিনীতে ভেটেরিনারি পেশার জন্য স্বতন্ত্র কোর রয়েছে। বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে বিভিন্ন ক্যারিয়ারের সুযোগও রয়েছেই। যেমন: পশু হাসপাতাল, ভেটেরিনারি ক্লিনিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগ, ব্যক্তিগত ক্লিনিক, ফার্ম, হ্যাচারি, মিলিটারি সার্ভিসেস, চিড়িয়াখানা, সাফারিপার্ক, সুন্দরবনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও চিকিৎসকের চাকুরী, ভ্যাটেনারি ফার্মাসিটিক্যালস কোম্পানি, ফিড কোম্পানি, উইল্ড লাইফ এজেন্সিজ, গবেষণাগারে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ব্যবস্থা। ভ্যাকসিম প্রোডাক্ট এবং আন্তর্জাতিক দেশীয় ঔষধ কোম্পানিতে ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও অনেক কাজ করা যায়।
দায়িত্ব
একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার যে সব কাজ বা দায়িত্ব পালন করেন সেগুলো হল: স্বাস্থ্য সমস্যা নির্ণয়ের জন্য পশুপাখিদের পরীক্ষা করা ও নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা সেবা দেয়া। পশুপাখি জখম হলে ড্রেসিং করা ও সারানো। প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করা। রোগের জন্য ভ্যাক্সিন ও টিকা দেয়া। চিকিৎসা সরঞ্জাম, যেমন এক্স-রে মেশিন পরিচালনা করা। সাধারণ যত্ন, চিকিৎসা শর্তাবলী, এবং চিকিত্সা সম্পর্কে পশু মালিকদের পরামর্শ দেয়া। প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধ দেয়া ইত্যাদি।
দক্ষতা ও জ্ঞান
ভেটেরিনারি মেডিসিন ডিগ্রি;
ভেটেরিনারি সার্জারি করার দক্ষতা;
দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা;
যোগাযোগ দক্ষতা;
পশুপাখির প্রতি ভালবাসা;
আয়
আমাদের দেশে প্রাণী চিকিৎসকদের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে চাকরির বাজার বেশ গরম, আমাদের দেশে এই বিষয়ে অনেক চাকরি রয়েছে। সরকারি ছাড়াও বিভিন্ন ফার্মগুলোতে চাকরি করা যায়। গতানুগতিক চাকরির চেয়ে বেতনও অনেক বেশি, শুরুতেই ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করা যায়। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে ফার্মগুলোতে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। তাছাড়া বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে চাকরি এবং চাকরির সুবাদে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
Leave a Reply