লরেন্স বিষ্ণোইয় – ছাত্রনেতা থেকে কুখ্যাত গ্যাংস্টার

ভারতের মহারাষ্ট্রের প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাবা সিদ্দিকীকে হত্যার পর থেকে সবার মুখে মুখে ঘুরছে একটাই নাম, লরেন্স বিষ্ণোই। বর্তমানে ভারতের গুজরাতের সবরমতী জেলে বন্দী। কিন্তু সেখান থেকেই চালাচ্ছেন অপরাধের সাম্রাজ্য। গত দুই বছরে তিনটি বড় খুনের ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়েছে। কানাডার পুলিশও নিজেদের হেফাজতে চাইছে বিষ্ণোইকে। এই গ্যাংস্টারের ভয়েই নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করা হয়েছে বলিউডের ‘ভাইজান’খ্যাত সালমার খান। অনেক দিন ধরে নায়ককে নিশানা করেছে বিষ্ণোই দল।

২০২২ সালে পঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালা হত্যাকাণ্ডে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নাম প্রথম লাইমলাইটে আসে। পরের বছর কানাডায় খালিস্তানিপন্থী হরদীপ সিং নিজ্জর খুনেও তাঁর নাম জড়িয়ে যায়। এরপর সম্প্রতিক ভারতের মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকিকে হত্যার পিছনেও বিষ্ণোইয়ের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই গ্যাংস্টারকে নিয়ে আমজনতার মনে ব্যাপক কৌতূহল। ৩২ বছর বয়সী এক যুবক জেল থেকে দুটি দেশের ৩টি বড় অপরাধ ঘটাচ্ছে, এটা মোটেই সাধারণ ব্যাপার নয়!

উত্থান

কুখ্যাত দুষ্কৃতীকারী লরেন্স বিশ্নোইয়ের জন্ম ভারতের পঞ্জাবে ১৯৯৩ সালে। গায়ের রং ব্যতিক্রমী রকমের ফরসা, যাকে প্রায় গোলাপি বর্ণ বলা যায়। ফলে তাকে দেখতে ভারতীয়র চেয়ে ঢের বেশি ইউরোপীয় মনে হয়। উত্তর ভারতে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ে লরেন্স নামটা এতটা প্রচলিত নয়। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ও প্রশাসক হেনরি লরেন্সের নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সেখানকার মানুষ এ নাম রাখেন। ঔপনিবেশিক আমলে হেনরি লরেন্স পাঞ্জাবে কর্মরত ছিলেন।

অবস্থাপন্ন পরিবারের লরেন্স বিষ্ণোইদের পাঞ্জাবের দত্তরানওয়ালি গ্রামে ১০০ একরের বেশি কৃষিজমি রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আইন নিয়ে পড়ার জন্য পাঞ্জাবের রাজধানী চণ্ডীগড়ের ডিএভি কলেজে। ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (স্টুডেন্স কাউন্সিল) সভাপতি ছিলেন বিশ্নোই। ওই সময়ে সতীনদরজিৎ সিংহ ওরফে গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর।

গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকেই বিশ্নোইয়ের জীবনে বড় পরিবর্তন আসে। ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। চণ্ডীগড়-সহ পঞ্জাবে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিতে গ্যাং তৈরি করেন বিশ্নোই ও ব্রার। ২০১৩ সালে এক ছাত্রনেতাকে খুনের ঘটনায় প্রথম বার খবরের শিরোনামে আসে বিশ্নোইয়ের নাম।

পরবর্তী সময়ে কলেবরে বাড়তে শুরু করে দুই গ্যাংস্টারের দলবল। চাঁদাবাজির পাশাপাশি যুক্ত হয় মাদক পাচার, মদের কালোবাজারি, আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাচালান ও অর্থের বিনিময়ে খুন।

গ্যাংয়ে রিক্যুরমেন্ট

ভারতের গোয়েন্দাদের দাবি, সমাজিকমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে যুবকদের দলে টানার সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করছে বিশ্নোইয়ের দল। সেখানে বিশ্নোইকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার ছবি বার বার পোস্ট করা হয়। যা দেখে অপরাধমনস্ক বহু যুবক তাঁর গ্যাংয়ে যোগ দিচ্ছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

গ্যাং বাড়ানোর দ্বিতীয় পদ্ধতি হল কানাডা পাড়ি দেওয়ার লোভ। পঞ্জাবের অনেক গরীর যুবকই ভাগ্যের সন্ধানে উত্তর আমেরিকার দেশটিতে পাড়ি জমাতে চান। এঁদেরকেই নিশানা করে বিশ্নোই-ব্রারের দলবল।

ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (ন্যাশনাল ইনভেস্টটিগেশন এজেন্সি বা এনআইএ) দাবি, পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া খালিস্তানি জঙ্গি হরবিন্দর সিংহ রিন্ডা বিশ্নোই গ্যাংয়ের শুটারদের টার্গেট কিলিংয়ের জন্য ব্যবহার করছে। বিশ্নোই গ্যাং পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের থেকে টাকা পায় বলেও চার্জশিটে জাতীয় তদন্তকারীরা উল্লেখ করেছেন।

জেল থেকেই অপরাধ

সবচেয়ে বড় কথা হল, জেল থেকে বিষ্ণোই কাজ করছেন। কিন্তু কীভাবে? তাঁর কী কোনও গডফাদার আছে? ২২ বছর বয়স থেকে জেলে। কিন্তু ১০ বছরেও দাপট কমেনি একচুলও। কোথা থেকে এত সাহস পান?

জেলে লরেন্স বিষ্ণোইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এক ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিন্দুস্তান টাইমস-কে বলেছেন, অন্যান্য গ্যাংস্টারের মতো বিষ্ণোইয়ের কোনও গডফাদার নেই। নিজেকেই সে নিজের জীবনের নায়ক মনে করে।

বিষ্ণোইকে কখনওই এক জেলে বেশিদিন রাখা হয় না। কিছুদিন পরপর জেল বদলানো হয়। তাছাড়া জেলের ভিতরেও একা থাকেন না বিষ্ণোই। সবসময় নজরদারি চলে।

এনআইএ’র চার্জশিট অনুযায়ী, বিশ্নোই গ্যাংয়ে রয়েছে ৭০০ শুটার। সুপারি কিলিংয়ে (টাকা নিয়ে খুন) যারা সিদ্ধহস্ত। এই ভাড়াটে খুনির দল সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে রয়েছে পঞ্জাবে। সেখানে বিশ্নোই গ্যাংয়ের ৩০০ শুটার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বলে দাবি এনআইয়ের । জিজ্ঞাসাবাদে গ্যাংস্টার নিজেই একবার বলেছিলেন, যে কোনও দেশে যে কোনও রকম অপারেশন তিনি চালাতে পারেন। শুধু সেই দেশে ভারতীয় যুবক থাকলেই হবে।

উল্লেখ্য, গ্যাংস্টার বিশ্নোই এবং গোল্ডি ব্রারের যুগলবন্দিকে ইতিমধ্যেই ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড দাউদ ইব্রাহিম কাসকরের তৈরি ‘ডি কোম্পানি’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন এনআইএর গোয়েন্দারা। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যাঁদের নামে কাঁপত গোটা মুম্বই-সহ মহারাষ্ট্রের ফিল্মি দুনিয়া থেকে নামী শিল্পপতিরা।

‘ডাব্বা কলিং’

লরেন্স বিশ্নোইর হুমকি ফোন বা চাঁদাবাজি সংক্রান্ত তদন্তের কিনারা করতে গিয়ে এক প্রকার হিমশিম খেতে হচ্ছে ভারতের তদন্তকারীদের। আর তাতেই জানা গেছে নতুন এক অপরাধ পদ্ধতির নাম ‘ডাব্বা কলিং’।

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা তোলে মূলত বিদেশে বসবাসকারী গ্যাংস্টারেরা। ‘ডাব্বা কলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা তোলে মূলত বিদেশে বা জেলে বসবাসকারী গ্যাংস্টারেরা।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লরেন্সের মতো গ্যাংস্টারেরা প্রথমে ঠিক করে যে কোন বিত্তশালীর থেকে টাকা চাওয়া হবে। এর পর টাকা তুলতে দেশে থাকা তাদের দালালদের কাজে লাগায় ওই অপরাধীরা। গ্যাংস্টারের স্থানীয় সহযোগীরা প্রথমে মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে ‘টার্গেট’কে ফোন করেন। এর পর অন্য একটি মোবাইল থেকে ফোন করা হয় বিদেশে বা জেলে বসে থাকা বস্‌কে।

দু’টি ফোনই স্পিকারে দিয়ে পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয়। এর পর গ্যাংস্টার বিত্তশালী টার্গেটকে ‘প্রোটেকশন মানি’ বা অন্য কোনও সাঙ্কেতিক শব্দ ব্যবহার করে টাকা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু দু’জনের মধ্যে সরাসরি কথা হয় না।

যে হেতু গ্যাংস্টারের মোবাইল থেকে সরাসরি ফোন আসে না, তাই তদন্তকারীরা প্রমাণও হাতে পায় না।

সালমান খানকে হত্যার চেষ্টা

এনসিপি (জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি) নেতা তথা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকিকে গুলি করে হত্যা করার দায় স্বীকার করেছে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং। একইসঙ্গে সাফ জানিয়ে দেয়, সালমান খানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কারণেই এই চরম পরিণতি।

লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের তরফ থেকে একাধিকবার হুমকি পেয়েছেন সলমন খান। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল বান্দ্রায় তাঁর বাসভবনের সামনে গুলিও চলে।

সলমন খান এবং লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ঝামেলার সূত্রপাত ১৯৯৮ সালে। ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়ে যোধপুরে একটি কৃষ্ণসার হরিণ হত্যায় অভিযুক্ত হন সলমন খান। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। তবে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের লরেন্স শপথ করে, তাঁদের ধর্মে পবিত্র কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার বদলা নিয়েই ছাড়বেন।

বিশ্নোইয়ের ‘হিট লিস্ট’

ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ সূত্রে জানা গেছে, লরেন্স বিশ্নোইয়ের হিট লিস্টে সলমান খান ছাড়াও বেশ কিছু পরিচিত ব্যক্তির নাম রয়েছে। এই তালিকার রয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ জিশান সিদ্দিকি (বাবা সিদ্দিকির ছেলে)। এছাড়া, কৌতুকশিল্পী মুনাওয়ার ফারুকীও রয়েছেন, যাকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্নোই ‘ডন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে চেয়েছিলেন। আরও আছেন গ্যাং প্রতিদ্বন্দ্বী কৌশল চৌধুরী এবং সাবেক সহযোগী গোল্ডি ব্রার।

ভারতীয় এজেন্টদের কেউ কেউ বিশ্নোই গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত!

দক্ষিণ এশিয়ায় স্বার্থসিদ্ধিতে লরেন্স বিশ্নোইয়ের দুষ্কৃতী দলকে কাজে লাগায় ভারত। এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ কানাডা পুলিশের। অভিযোগ, কুখ্যাত অপরাধীদের কাজে লাগিয়েই কানাডায় দক্ষিণ এশিয়া এবং খলিস্তানপন্থীদের গতিবিধির উপর নজর রাখে ভারত।

কানাডা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তদের দাবি, বিশেষ করে বিশ্নোই গ্যাংয়ের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে ভারতীয় এজেন্টদের। অভিযোগ, কানাডাবাসী দক্ষিণ এশীয়দের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে তাঁরা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িতদের সাহায্য নেন। এমনকি কখনও কখনও চাঁদাবাজি থেকে খুন— সবই করানো হয় তাঁদের মদতেই।

বিষ্ণোইয়ের জীবনকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ

কুখ্যাত গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের জীবন নিয়ে নতুন একটি ওয়েব সিরিজ তৈরি হতে যাচ্ছে, যার নাম রাখা হয়েছে ‘লরেন্স-আ গ্যাংস্টার’। ফায়ার ফক্স প্রযোজনা সংস্থা সিরিজটি নির্মাণ করছে এবং ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে অনুমোদন পেয়েছে। সিরিজে লরেন্সের জীবনের নানা কীর্তি তুলে ধরা হবে, বলা যেতে পারে একেবারে রগরগে থ্রিলার তৈরির কথা ভাবছে প্রযোজনা সংস্থা।

নায়ক হিসেবে কাকে দেখা যাবে তা এখনও ঠিক হয়নি, তবে শোনা যাচ্ছে, দিওয়ালিতে সিরিজের প্রথম পোস্টার প্রকাশিত হবে।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *