কৃষিকে এগিয়ে নিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন কৃষি প্রকৌশলীরা। যা কৃষকের শ্রম, সময় ও ব্যয় কমিয়ে সর্বোচ্চ উৎপাদনে সহায়তা করে। কৃষি প্রকৌশল পড়ে সরকারি ও বেসরকারি অনেক ভালো চাকরি পাওয়া যায়। কৃষিবিষয়ক চাকরি ক্ষেত্রেও এগিয়ে থাকেন কৃষি প্রকৌশলীরা।
কৃষি প্রকৌশল পড়ে চাকরি
কৃষি প্রকৌশল কি?
কৃষি প্রকৌশল হচ্ছে কৃষি পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রকৌশল। কৃষি প্রকৌশল পুরকৌশল, যন্ত্রকৌশল, রাসায়নিক কৌশল, তড়িৎ কৌশল ও খাদ্যবিজ্ঞান ও কৃষি বিজ্ঞান এর মধ্যে সমন্বয় ঘটায়। কৃষি উৎপাদনে স্থায়িত্ব ও উপযুক্ত কার্য ক্ষমতা প্রদর্শন হচ্ছে এই বিষয়ের মূল লক্ষ্য।
কৃষি প্রকৌশলের সূচনা হয় যখন থেকে কৃষিতে সেচ ব্যবস্থার ব্যবহারের শুরু হয়। সেচ ব্যবস্থা শিল্প বিপ্লবের আগ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়নি।
ট্রাক্টর এবং অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতির আবিষ্কার কৃষিতে নতুন বিপ্লবের সূচনা করে। পরে যান্ত্রিক কর্তনযন্ত্র ও বুননযন্ত্র ২০ শতকে হাতে কৃষিকাজের পরিমাণ বলতে গেলে কমিয়ে দেয়। পরে ২০ শতকে ক্রপডাস্টারের আবির্ভাবে ফসলে কীটনাশক ছিটানো সহজ হয়ে যায়। কৃষিক্ষেত্রে এই সব প্রকৌশল শাস্ত্রীয় কনসেপ্ট প্রয়োগের ফলে কৃষিক্ষেত্রে এক ধরনের বিপ্লব ঘটে যাকে ২য় কৃষি বিপ্লব বলে।
২০ শতকের শেষে Genetically Modified Foods (GMOs) তৈরি করা হয় যাতে করে ফসলের মোট উৎপাদন বাড়ে ও কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
কৃষি প্রকৌশলী কে?
কৃষি প্রকৌশলীগণ হচ্ছেন সেই বিশেষজ্ঞ যারা কৃষি উপকরণ, কৃষি খামার কৃষি যন্ত্রপাতি নকশা, পরিকল্পনা সেচ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, দুগ্ধখামার নিয়ন্ত্রণ, পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদি সহ পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনার কাজ করেন। অনেক কৃষি প্রকৌশলী শিক্ষাজগতে কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অনেক কৃষি প্রকৌশলী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ কাজ করেন। কেউ কেউ কনসালটেন্সি করে থাকেন। অনেকে উৎপাদন, বিক্রয়, ব্যবস্থাপনা, গবেষণা ও উন্নয়ন বিষয়ে ও কাজ করে থাকেন। যুক্তরাজ্যে যারা কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত করেন তাদেরকেও কৃষি প্রকৌশলী বলা হয়।
কৃষি প্রকৌশলীরা নিম্নলিখিত বিভাগ গুলোতে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন:
- কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি অবকাঠামো ও কৃষি উপকরণ তৈরি ও নকশা করতে পারেন
- অন্তঃতাপীয় ইঞ্জিনকে কৃষি ক্ষেত্রে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
- কৃষি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ( ভূমি ব্যবহার ও পানি ব্যবহার সহ।)
- পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা
- ভূমি জরিপ
- মাটি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
- জৈবসম্পদ প্রকৌশল
- শস্য ব্যবস্থাপনা ও গুদামজাতকরন
- শস্য ও প্রাণী উৎপাদন এর সাথে সম্পর্কিত এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন
- খাদ্য প্রকৌশল ও কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ।
- সার্কিট বিশ্লেষণের মূল নীতি।
- কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত বস্তু সমূহের ভৌতিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য।
পড়াশোনা
বিশ্বের অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি প্রকৌশল বিষয়ক কোর্স চালু আছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ানো হয় যা ক্যারিয়ার এ এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে কৃষি প্রকৌশল এবং জৈব প্রকৌশলের উপর বিভিন্ন প্রোগ্রাম আছে। এসব প্রোগ্রাম এই ক্ষেত্রের উপর পড়াশোনার জন্যে জরুরী।
১৯০৫ কৃষি প্রকৌশলের প্রথম কারিকুলাম তৈরি করেন আইওয়া অঙ্গরাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জে.বি ডেভিডসন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি প্রকৌশলী ডিগ্রী প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৪ সালে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই অনুষদ থেকে বিএসসি এগ্রি. ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিএসসি ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং নামে ২টি ডিগ্রী দেয়া হয়।
যা পড়ানো হয়
৮টি সেমিস্টারের অধীনে ৪ বছর মেয়াদী বিএসসি এগ্রি. ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী প্রদান করা হয়। এছাড়া রয়েছে এমএস ও পিএইচডি করার সুযোগ। ৮টি সেমিস্টারে যা যা পড়ানো হয়:
সেমিস্টার ১ : ম্যাথমেটিক্স-১, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ, ইঞ্জিনিয়ারিং শপ, সয়েল সায়েন্স।
সেমিস্টার ২ : ম্যাথমেটিক্স ২, কম্পিউটার সায়েন্স, ওয়ার্কসপ টেকনোলজি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং, এগ্রোনমি, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সার্ভেইং।
সেমিস্টার ৩ : ম্যাথমেটিক্স ৩, এগ্রিকালচারাল ইকোনমিক্স, ফুড সায়েন্স, ফ্লুইড মেকানিক্স, থার্মোডায়নামিক্স, ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যাটেরিয়ালস, কম্পিউটার এ্যাপ্লিকেশন।
সেমিস্টার ৪ : ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স, হাইড্রোলিক্স, হিট ইঞ্জিন, স্ট্রেন্থ অফ ম্যাটারিয়ালস, ম্যাটারিয়াল এ্যান্ড কস্ট এসস্টিম্যাশন, রুরাল সোসিওলোজি, হর্টিকালচার, স্ট্যাটিসটিক্স।
সেমিস্টার ৫ : এগ্রিকালচারাল পাওয়ার, ইলেকট্রিক্যাল মেশিনারি, ইরিগেশন এ্যান্ড ড্রেনেজ ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্রাইন্ড ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং, সয়েল মেকানিক্স, কনক্রিট স্ট্রাকচার ডিজাইন।
সেমিস্টার ৬ : এগ্রিকালচারাল মেশিনারি, রুরাল ইলেট্রিফিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন এডুকেশন, কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স/ফার্ম পাওয়ার মেশিনারি/ফার্ম স্ক্রাকচার/ ইরিগেশন এ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট।
সেমিস্টার ৭ : এগ্রিকালচারাল ম্যাকানাইসেশন, পাম্পস এ্যান্ড ওয়েলস, সয়েল এ্যান্ড ওয়াটার কনজারভেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন, কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স/ফার্ম পাওয়ার মেশিনারি/ফার্ম স্ক্রাকচার/ইরিগেশন এ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট।
সেমিস্টার ৮ : ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট, অন ফার্ম ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট, কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স/ফার্ম পাওয়ার মেশিনারি/ফার্ম স্ক্রাকচার/ইরিগেশন এ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট
ল্যাব ও ওয়ার্কসপ : শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রয়েছে আধুনিক ল্যাবরেটরি ও ওয়ার্কসপ। কংক্রিট এবং ম্যাটেরিয়াল টেস্টিং ল্যাবরেটরি, হাইড্রলিক ল্যাবরেটরি, ইলেকট্রিক ল্যাব, হিট ইঞ্জিন ল্যাব, পোস্ট হারভেস্ট লস্ রিডাকশন ইনোভেশন ল্যাব। এছাড়া রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ। ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ এ রয়েছে ব্ল্যাকস্মিথ শপ, ওয়েল্ডিং শপ, কার্পেনট্রি শপ। এসকল ল্যাবরেটরি ও ওয়ার্কশপে কাজ করে শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করে তাদের কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
কাজের সুযোগ
কৃষির অভাবনীয় উন্নয়নে কৃষি প্রকৌশলীদের ভূমিকা অনেক। দিন দিন কৃষি প্রকৌশলীদের চাকরির ক্ষেত্র বাড়ছে। কৃষি প্রযুক্তিকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে উত্তীর্ণ গ্র্যাজুয়েটরা দেশের বিভিন্ন কৃষি সেক্টরগুলোতে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিরি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার এক্সটেনশন (ডিএই), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)। এছাড়া জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং, মাহবুব ইঞ্জিনিয়ারিং, এসিআই, সিনজেনটা, কাজী ফার্মসসহ সকল কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ থাকছে। অন্যদিকে সরকারী ও বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি এবং ভাল রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ থাকছে। একটু ভাল সিজিপিএ থাকলে খুব সহজেই ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কলারশিপসহ পড়াশোনা ও স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগও থাকছে।
আয় রোজগার
বাংলাদেশে সাধারণত কৃষি সম্পর্কিত যে কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন কৃষি প্রকৌশলীর বেতন সরকারি স্কেলেই ধার্য করা হবে। তাছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রথম অবস্থায় উচ্চ বেতন দিয়ে চাকরি শুরু হয়, দিন যত গড়াবে তত বেতন বাড়তে থাকবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অনেক উচ্চমানের বেতন দিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে শুরুতেই লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তথ্যসূত্র
১. কৃষি প্রকৌশল
Leave a Reply