সিভি তৈরি চাকরির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ! এর মাধ্যমে চাকরি-প্রার্থী সম্পর্কে প্রথম ইম্প্রেশন তৈরি হয়। প্রত্যেকেই চান তাঁর সিভি অন্যদের থেকে আকর্ষণীয় হোক। আর এই আকর্ষণীয় করতে গিয়েই হয় যত গণ্ডগোল! তাই সিভি তৈরিতে বেশি ‘ক্রিয়েটিভ’ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সিভিতে মেওয়া ফলে
জবরদস্ত একটা সিভি ঘুচিয়ে দিতে পারে বেকারত্ব। চাকুরী নামক সোনার হরিণটাকে ধরার প্রথম ধাপ এটি। সিভি বা কারিকুলাম ভাইটা হচ্ছে একজন ব্যক্তির পরিচয়, যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রাপ্তি, ইচ্ছা, ইত্যাদির রিপোর্ট। সিভিতে পেশাগত ও শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি আরো কিছু ব্যক্তিগত তথ্য যেমন নিজের পছন্দ, অপছন্দ, আগ্রহ, শখ, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ইত্যাদিও যোগ হয়। এটি চাকরিদাতার কাছে নিজেকে তুলে ধরার উপযুক্ত কৌশল। সিভির মাধ্যমেই কোন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান বা এ দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তার কাছে চাকরি-প্রার্থী সম্পর্কে প্রথম ইম্প্রেশন তৈরি হয়। প্রত্যেকেই চান তাঁর সিভি অন্যদের থেকে আকর্ষণীয় হোক। আর এই আকর্ষণীয় করতে গিয়েই হয় যত গণ্ডগোল! অর্থাৎ, নিজেকে অনেক দক্ষ আর যোগ্য প্রমাণ করতে গিয়ে ভুল তথ্য, অসত্য, কিংবা সত্যের বিকৃতি করে তথ্য উপস্থাপন করতে গেলে, চাকরীতো হবেই না উল্টো বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সিভি তৈরিতে বেশি ‘ক্রিয়েটিভ’ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সিভির রকমফের
- ক্রোনোলোজিক্যাল সিভি: কেউ একই সেক্টরে থেকে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাল্টাতে চায় তাহলে ক্রোনোলোজিক্যাল সিভি ভালো ফরম্যাট। ক্রোনোলোজি বলতে কালানুক্রম বোঝায়। এ ফরম্যাটে ক্যারিয়ার হিস্টোরি সাজাতে হয় কালানুসারে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক চাকরির অবস্থানকে প্রথমে দিয়ে পর পর অন্য চাকরির অভিজ্ঞতা দিতে হবে।
- ফাংশনাল সিভি: ক্যারিয়ার ট্র্যাক পরিবর্তন করতে চায় তাহলে ফাংশনাল সিভি ভালো। ফাংশনাল বলতে প্রায়োগিক বোঝায়। কারণ এ সিভিতে অর্জন এবং কাজকে হাইলাইট করা হয়। এমনকি দক্ষতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপাদান, বিশেষজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে দিতে হয়। এধরণের সিভিতে কাজের ধরণ এবং প্রতিষ্ঠানের নাম খুব একটা গুরুত্ব পায় না। ফাংশনাল সিভিতে কাজের দক্ষতাকে সবচেয়ে বেশি লাইন আপ করা হয় মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
- টার্গেটেড সিভি: টার্গেটেড সিভি বা লক্ষ্যের সিভি নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিশেষভাবে তুলে ধরতে প্রার্থী আবেদন করে। কোনো ব্যক্তির ক্যারিয়ার জীবনের অর্জন এবং সক্ষমতাকে লক্ষ্য করে এ সিভি। যদি নির্দিষ্ট কোনো চাকরি বা কাজের জন্য সিভি প্রয়োজন হয় তার জন্য খুব ভালো ফরম্যাট এই সিভি।
- অল্টারনেটিভ সিভি: অল্টারনেটিভ সিভি বা বৈকল্পিক সিভি ক্রিয়েটিভ ফিল্ডে কাজ করতে আগ্রহীদের জন্য। অ্যাড ডিজাইন, মিডিয়া অথবা পাবলিক রিলেশনের মতো ব্যক্তিনির্ভর কাজের জন্য এ সিভি উপযুক্ত।
সিভি সাজানোর কৌশল
‘আগে দর্শন ধারী তারপর গুণবিচারী’ কথাটি সিভির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পেশাদারিত্বের মধ্যে আপনি যখন প্রবেশ করবেন, তখনই সিভি-টিও হতে হবে যত দূর সম্ভব পেশাদার। এক্ষেত্রে কতগুলি সহজ রাস্তা মাথায় রাখুন।
- সিভি ইংরেজিতে তৈরি করা ভাল তবে প্রতিষ্ঠানের নীতি অনুসারে তা বাংলায়ও হতে পারে। ইংরেজিতে সিভি তৈরি করলে লেখার ফন্ট টাইমস্ নিউ রোমান, আর বাংলায় হলে সুতনি এমজে রাখুন। ফন্ট সাইজ হবে ১২ এবং লাইন স্পেস দেবেন ১.৫। সিভির প্রধান শাখাগুলো অবশ্যই চোখে পড়ার মত বোল্ড করে দিন।
- সিভি’র প্রথম থেকে পয়েন্ট-গুলো এমনভাবে সাজানা, যাতে নিয়োগকর্তারা পরের অংশটি পড়তে আকৃষ্ট হন।
- সিভি-তে শুধু শুধু অতিরঞ্জন আনবেন না। বরং একেবারে সত্যি কথাটি পরিষ্কার করে লিখুন। নিজের শক্তির জায়গাগুলো, আর দুর্বলতার জায়গাগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন। এতে নিয়োগকর্তাদের বিশ্বাস অর্জন করাটা আপনার পক্ষে সুবিধাজনক হবে।
- শুরুটা হবে যেভাবে সিভির প্রথমেই থাকবে সাম্প্রতিক তোলা ছবি এবং পত্র যোগাযোগের ঠিকানা, সিভির ভাষা হবে সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত। কড়া নজর রাখতে হবে, যেন কোন তথ্যের পুনারাবৃত্তি না ঘটে। সিভি দুই পৃষ্ঠাার বেশি না বাড়ানোই ভালো। তবে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা ভেদে তার ব্যতিক্রম ঘটবে।
- এমনভাবে সিভি বানাতে হবে, যাতে প্রধান বিষয়গুলো সহজেই নজরে পড়ে যায়। এজন্য পরিচ্ছন্ন সিভি হওয়া খুব দরকারি। তিনটি জিনিস বজায় রাখা দরকারি। (১) বাক্য যেন একেবারে সোজাসাপ্টা হয়। (২) ছোট বাক্য লিখুন। দরকার মতো বুলেট ব্যবহার করুন। (৩) হেডিং আর তারিখ যেন মূল টেক্সট-এর ফন্ট সাইজের থেকে আলাদা হয়। যাতে সেগুলোকে মূল টেক্সটের অংশ বলে মনে না হয়।
- কোন ভাষা শিক্ষা,কম্পিউটার কোর্স ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করলে তাও তুলে ধরা প্রয়োজন কারণ তা অভিজ্ঞতা ও বহুবিধ জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে।
- শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে ততটুকুই বলুন, যেটুকু দরকারি। বেশি বর্ণনায় যাওয়াটা মোটেই কাজের কথা হবে না। বরং নির্দিষ্ট কাজের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশ নিয়ে থাকলে, তা উল্লেখ করুন স্পষ্টভাবে।
- যদি কাজের সুবাদে কোনও পুরস্কার কিংবা স্বীকৃতি পেয়ে থাকেন, তা ভালো করে হাইলাইট করুন। মনে রাখবেন, পেশার জগতে নিজের দক্ষতাকে বিক্রি করতে পারাটাই আসল লক্ষ্য।
- মনে রাখবেন, নিয়োগকর্তারা চাকরিতে একজন মানুষকে নিতে চান, যন্ত্রমানবকে নয়। তাই শখের জন্য একটি সাবহেড আলাদা করে তৈরি করতেই পারেন। কে বলতে পারে, ওই শেষ পয়েন্ট-টিই হয়তো বাকি সিভি-র থেকে আপনার সিভি-টিকে আলাদা করে চোখে পড়িয়ে দেবে। শিক্ষাজীবনে এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি থাকলে তা লিখতে পারেন, কারণ তার মাধ্যমে আপনার টিম ওয়ার্ক এবং সমাজসেবার ইচ্ছার প্রতিফলন হবে।
- রেফারেন্স সিভিতে রেফারেন্স দিতে হয়। এমন দু’জন ব্যক্তির রেফারেন্স দিবেন যারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও আপনার সুপরিচিত। তাদের পূর্ণ ঠিকানা দিবেন এবং আপনি যে সিভিতে ঐ দুজন ব্যক্তির রেফারেন্স দিয়েছেন তা ব্যক্তিদ্বয়কে জানিয়ে দিন যাতে অবাঞ্ছিত সমস্যা এড়ানো যায়।
- প্রত্যয়ন সিভি লেখার শেষে প্রত্যায়িত করতে ভুলবেন না। এই প্রত্যায়িত হবে স্ব-প্রত্যায়িত অর্থাৎ উপরোক্ত সব তথ্য সঠিক ঘোষণা করে প্রত্যয়ন করবেন এতে আপনার সত্যবাদী চেতনা ও আত্মপক্ষ সমর্থনের আগ্রহের প্রকাশ পাবে।
জার্নি টু ওয়েস্ট বক্স
বেকারত্বের এ দেশে একটা পদের জন্য জমা পড়ে সহস্র সিভি। আজকাল অনেক চাকরিদাতা ব্যক্তি প্রতিটা আবেদনের সাথে আকর্ষণীয় কোন সিভি না পেলে বেশিরভাগ সময় পুরো সিভি না পড়েই ফেলে দেয়। সাধারণ যেসব কারণে সিভি বাদ পড়ে সেগুলো হল:
- টু দি পয়েন্টের অভাব থাকলে।
- সিভি অতিরিক্ত তথ্য দিয়ে বড় করলে।
- সফলতার বিষয়কে প্রাধান্য না দিলে।
- ব্যাকরণজনিত ভুল থাকলে।
- একটি সিভি সব জায়গায় পাঠানো।
- সিভির অনির্দিষ্ট লক্ষ্য।
- প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকলে।
- যোগাযোগ বিষয়ক তথ্য বারবার পরিবর্তন করলে।
যে পয়েন্টগুলো সিভিতে কখনওই রাখবেন না
অনেকের ধারণা রয়েছে যত পাতার সিভি হবে চাকুরীদাতা তত বেশি খুশি হবেন। ব্যাপারটি একেবারেই সত্যি নয়। অতিরিক্ত তথ্যবহুল সিভি আখেরে উপকারের থেকে অপকারই বেশি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাকে চাকরি দেওয়া হবে বা হবে না, সেটা নির্ণয় করতে প্রাথমিকভাবে ৬ সেকেন্ড সময় নেন রিক্রুটমেন্ট অফিসার। এই সময়ের মধ্যে যদি আপনাকে পছন্দ হয়, তবেই আপনার সিভি প্রাথমিক তালিকায় যাবে। এ জন্য যা করবেন:
- সিভি সংক্ষিপ্ত করে অর্থাৎ, টু দি পয়েন্ট তৈরি করুন। আপনার সম্পর্কে যেটা না জানালেই নয় সেটাই রাখুন।
- বুঝে শুনে অভিজ্ঞতার কথা লিখুন। খুব অল্প দিনের জন্য কাজ করার অভিজ্ঞতা না লেখাই ভালো।
- ব্যক্তিগত তথ্য যা না জানালেই নয়, তা রাখুন। কর্তৃপক্ষের আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আগ্রহ থাকলে জিজ্ঞাসা করে নিবে। আলাদা করে দেওয়ার দরকার নেই।
- সিভিতে মিথ্যা তথ্য লিখবে যাবেন না। মনে রাখবেন, মিথ্যা ধরা পড়ে গেলে চাকরি তো হবেই না। উল্টো বিপদে পড়বেন।
- স্যালারির কথা সিভিতে উল্লেখ করার দরকার নেই। আপনাকে পছন্দ হলে কর্তৃপক্ষ আপনার কাছে চেয়ে নেবে।
- বর্তমান চাকুরীর বিস্তারিত তথ্য দেয়ার দরকার নেই। এতে অন্য কোথাও চাকুরীর সম্ভাবনা তৈরির আগেই আপনার বর্তমান কর্মস্থলে খবর চলে আসতে পারে। এতে অনাহুত সমস্যা তৈরি হবে।
- কেন চাকরি বদলাতে চাইছেন এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অযথা আগ বাড়িয়ে বলতে গেলে বেকার সমস্যায় জড়াতে পারেন। যদি অন্য কোনও সমস্যা থেকেও থাকে, সেটা বলার জন্য সময় রয়েছে।
- সিভিতে নিজের সম্পর্কে অযথা ঢোল পেটানোর দরকার নেই। ইন্টার্ভিউ নেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ বুঝে নিতে পারবে আপনি কী বা কে।
Leave a Reply