২০২৫ সালে বিশ্বের শীতলতম ১০ শহর: তীব্র শীতের সঙ্গে জীবনযাত্রার চ্যালেঞ্জ

২০২৫ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহরগুলির মধ্যে ১০টি শহর হবে: ইয়াকুতস্ক (রাশিয়া), উলানবাটর (মঙ্গোলিয়া), হারবিন (চীনা), অ্যাঙ্কোরেজ (আলাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র), ইয়েলোনাইফ (কানাডা), হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ড), অসলো (নরওয়ে), ইক্যালুইট (কানাডা), মাগাদান (রাশিয়া), এবং ফেয়ারব্যাঙ্কস (আলাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র)। এই শহরগুলি পৃথিবীর কিছু শীতলতম জায়গা হিসেবে পরিচিত এবং ২০২৫ সালে এগুলির তাপমাত্রা সম্ভবত বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন থাকবে। আমরা এই শহরগুলির শীতকালীন তাপমাত্রা, স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ, এবং এই শহরগুলিতে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

১. ইয়াকুতস্ক (রাশিয়া)

পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহর হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার সাখা রিপাবলিকের রাজধানী ইয়াকুতস্ক। সাইবেরীয় এই শহরটিতে শীতকাল প্রায় ৭ মাস স্থায়ী হয়, এবং তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামতে পারে। ২০২৫ সালে এই শহরে তাপমাত্রার আরও সর্বনিম্ন স্তর দেখা দিতে পারে। পৃথিবীর উত্তরমেরু থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে ইয়াকুতস্ক শহরের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল -৬৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা পৃথিবীর অন্যতম শীতলতম তাপমাত্রা। এই শহরে বসবাসকারী মানুষজন অত্যন্ত ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে চলতে অভ্যস্ত, এবং ঘরবাড়ি গুলো অত্যন্ত উষ্ণ রাখতে হয়। ২০২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ইয়াকুতস্ক শহরের লোকসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৫৫ হাজার। বাসিন্দাদের অধিকাংশ খনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বাঁধাকপির মতো করে স্তরের পর স্তর করে পোশাকে আবৃত থাকতে হয় তাদের।

২. উলানবাটর (মঙ্গোলিয়া)

বিশ্বের শীতলতম রাজধানী উলানবাটর মঙ্গোলিয়ার রাজধানী, এবং সর্ববৃহৎ শহর এখানকার শীতকাল খুবই তীব্র এবং দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। ২০২৫ সালে এই শহরে তাপমাত্রা -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি নেমে যেতে পারে, যা এখানে সাধারণ ব্যাপার। ১৯৭৮ সালে এখানে তাপমাত্রা -৪০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। শহরের অবস্থান ও ভূতাত্ত্বিক কারণের জন্য এখানে শীতকাল দীর্ঘ এবং অতি শীতল হয়। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশের বসবাস এ শহবে। জনসংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ। এখানকার মানুষ শীত থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ পোশাক এবং উপকরণ ব্যবহার করে, যেমন পশমের পোশাক এবং উষ্ণ ঘর। উলানবাটার বায়ুদূষর্ণে অন্যকম শীর্ষ শহর। এছিড়া পর্যচকদের জন্যও অন্যতম শীর্ষ অনিরাপদ শহর। রাস্তায়, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে, দোকানে, মার্কেটে পকেটমার এবং চোরদের উৎপাত থাকে।

৩. হারবিন (চীন)

উত্তর-পূর্ব চীন এর হেইলংজিয়াং প্রদেশের রাজধানী হারবিন,’আইস সিটি’ নামে পরিচিত। চীনের প্রধান শহরগুলির মধ্যে এই শহরে সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে। বার্ষিক হারবিন আন্তর্জাতিক বরফ ও তুষার ভাস্কর্য উৎসবের জন্য বিশ্বজুড়ে এই শহর বিখ্যতি। ঐতিহাসিকভাবে রুশ ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত হারপিন শহর বর্তমানে চীনা-রুশ বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। ২০০৪ সালে শহরটি চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন শহর হিসেবে ভোটে নির্বাচিত হয়।

১ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার এই শহরের কেবল মূল অংশেই ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। এখানে তাপমাত্রা -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামতে পারে, এবং কখনও কখনও -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও পৌঁছায়। হারবিনে শীতকাল এতটাই তীব্র যে শহরের বাসিন্দারা প্রতিদিনের জীবনে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হয়। তীব্র শীতের কারণে এখানকার নির্মাণ এবং পরিবহন ব্যবস্থা বিশেষভাবে শীতের জন্য প্রস্তুত থাকে।

৪. অ্যাঙ্কোরেজ (আলাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র)

আলাস্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষ শীতল অঞ্চল, এবং অ্যাঙ্কোরেজ এই অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহর। এই শহরে শীতকালিন তাপমাত্রা প্রায়ই -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়, এবং কখনও কখনও -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও দেখা যায়। অ্যাঙ্কোরেজের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আরো কঠিন শীতের পরিস্থিতি দেখা যায়, এবং সেখানে প্রায়ই তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও নিচে নেমে যায়। এই শহরটির বাসিন্দাদের শীতকালীন অত্যন্ত কঠোর পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে হয়।

৫. ইয়েলোনাইফ (কানাডা)

ইয়েলোনাইফ কানাডার উত্তরপশ্চিম অধীনস্থ অঞ্চলসমূহের রাজধানী এবং একমাত্র শহর। এখানে শীতকাল প্রায় ৬ মাস স্থায়ী হয় এবং তাপমাত্রা প্রায়ই -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। ২০২৫ সালে এই শহরের শীত আরও তীব্র হতে পারে। এখানে অরোরা বোরিয়ালিস (উত্তর মেরু অঞ্চলের আকাশে সৃষ্ট আলো) দেখার জন্য প্রচুর পর্যটক আসে। তবে শীতের কারণে এখানে জীবনযাত্রা বেশ কঠিন।

১৯৩৪ সালে ইয়েলোনাইফে বসতি স্থাপন শুরু হয়। ঐ সময় এ এলাকায় সোনা আবিষ্কৃত হয়। ইয়েলোনাইফ দ্রুতই উত্তরপশ্চিম অধীনস্থ অঞ্চলসমূহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৬৭ সালে এটি রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। সোনা উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকলে ১৯৮০-র দশকে খনিশহরের জৈলুস কমতে থাকে। তবে ১৯৯১ সালে ইয়েলোনাইফের উত্তরে হীরা আবিষ্কৃত হলে আবারো শহরটির অর্থনীতি এগিয়ে যেতে থাকে। ২০ হাজার লোকের এই শহর একইসাথে পর্যটন, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বিকশিত হয়েছে।

৬. হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ড)

 ফিনল্যান্ডের রাজধানী ও প্রধান শহর ও সর্বাধিক জনবহুল শহর। তীব্র শীতের কারণে এটি ইউরোপের অন্যতম শীতল শহরগুলির মধ্যে একটি। এখানে তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামতে পারে, এবং শীতকাল প্রায় ৪-৫ মাস স্থায়ী হয়। তবে, ফিনল্যান্ডের মানুষের শীতের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী উপায় রয়েছে, যেমন সনা এবং প্রচুর পরিমাণে উষ্ণ খাবার। এই শহরটির প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ নাগরিকেরা শীতের মধ্যে অভ্যস্ত এবং শীতকালীন পরিবেশের সাথে ভালভাবে মানিয়ে নিতে সক্ষম।

জীবনযাত্রার মানের বিচারে হেলসিংকির বিশ্বের অন্যতম উচ্চমানের শহর। ব্রিটিশ ম্যাগাজিন মনোকল তার বাসযোগ্য শহরগুলোর সূচকে হেলসিংকিকে বিশ্বের সর্বাধিক বাসযোগ্য শহর হিসাবে স্থান দিয়েছে। 

৭. অসলো (নরওয়ে)

অসলো, নরওয়ের রাজধানী, উত্তর ইউরোপের শীতল শহরগুলির মধ্যে একটি। এখানে শীতকাল দীর্ঘ এবং তীব্র হয়, এবং তাপমাত্রা প্রায় -১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। তুষারপাত এবং বরফের কারণে এই শহরটির বাসিন্দাদের শীতের মৌসুমে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয়। তবে, অসলো শহরে তীব্র শীতের পরও নগরজীবন সমৃদ্ধ এবং বিভিন্ন শীতকালীন ক্রীড়াযজ্ঞ ও উৎসবের জন্য বিখ্যাত।

৮. ইক্যালুইট (কানাডা)

ইক্যালুইট, কানাডার একটি ছোট শহর, যার অবস্থান ক্যানাডিয়ান আর্কটিক অঞ্চলে। এই শহরের তাপমাত্রা সাধারণত -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকে এবং শীতকাল বেশ দীর্ঘ ও তীব্র হয়। ২০২৫ সালে, এটি পৃথিবীর শীতলতম শহরগুলির মধ্যে একটি হতে পারে। এখানে জীবনের জন্য কঠিন শীতের পরিবেশে মানুষ অনেকটা আদিবাসী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত।

৯. মাগাদান (রাশিয়া)

মাগাদান, রাশিয়ার একটি শহর, যা প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। এই শহরে শীতকাল তীব্র এবং দীর্ঘ থাকে, এবং তাপমাত্রা প্রায়ই -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। মাগাদান অঞ্চলে শীতের সাথে খাপ খাইয়ে জীবনযাপন করা বেশ কঠিন, তবে স্থানীয় মানুষদের জন্য এটি স্বাভাবিক এক অভিজ্ঞতা। শীতকালের সময় বিশেষ পোশাক এবং ঠাণ্ডার বিরুদ্ধে অন্যান্য ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়।

১০. ফেয়ারব্যাঙ্কস (আলাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র)

ফেয়ারব্যাঙ্কস, আলাস্কার একটি শহর, যা পৃথিবীর শীতলতম শহরগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এখানে তাপমাত্রা প্রায়ই -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়, এবং শীতকাল খুবই দীর্ঘ ও কঠিন হয়ে থাকে। ফেয়ারব্যাঙ্কসের বাসিন্দারা শীতের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং ঠাণ্ডা সহ্য করার জন্য নানা ধরণের উপকরণ ব্যবহার করে।

উপসংহার

২০২৫ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহরগুলির মধ্যে তাপমাত্রা আরও তীব্র হতে পারে। এই শহরগুলির বাসিন্দারা শীতের সাথে মানিয়ে নিতে যেসব উপায় অবলম্বন করে, তা প্রকৃতির প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতার উদাহরণ। পৃথিবীর এসব শীতল শহরগুলির শীতকালীন জীবনযাত্রা প্রমাণ করে যে, মানব সভ্যতা এমন এক পরিবেশে উন্নতি করতে সক্ষম, যেখানে অন্যথায় জীবনযাপন করা কঠিন হতে পারে।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *