স্বাধীনতাযুদ্ধ স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য
মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মৃতিকে লালন করার জন্য এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রবাহিত করার জন্য স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের নানা প্রান্তরে নির্মিত হয়েছে নানা ধরণের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। এই সব ভাস্কর্য সৃজনশীল শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ইতিহাসের সব চেয়ে গৌরবময় সময়ের কথা।
জাগ্রত চৌরঙ্গী
মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য আত্মত্যাগের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য। এটি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় নির্মিত এটিই প্রথম ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চের আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। আর এই প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ হুরমত উল্যা ও অন্য শহীদদের অবদান এবং আত্মত্যাগকে জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে স্থাপন করা হয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম জাগ্রত চৌরঙ্গী। ডান হাতে গ্রেনেড, বাঁ হাতে রাইফেল। লুঙ্গি পরা, খালি গা, খালি পা আর পেশিবহুল এ ভাস্কর্যটি ভিত বা বেদিসহ উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি। ২৪ ফুট ৫ ইঞ্চি ভিত বা বেদির ওপর মূল ভাস্কর্যের ডান হাতে গ্রেনেড ও বাঁ হাতে রাইফেল। কংক্রিট, গ্রে সিমেন্ট, হোয়াইট সিমেন্ট ইত্যাদি দিয়ে ঢালাই করে নির্মিত এ ভাস্কর্যটিতে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০০ জন ও ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন শহীদ সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম উৎকীর্ণ করা আছে। শিল্পী আবদুর রাজ্জাক জাগ্রত চৌরঙ্গী’র ভাস্কর।
অপরাজেয় বাংলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা তিন নারী-পুরুষের ভাস্কর্য যেটি সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সেটি ‘অপরাজেয় বাংলা’। এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙ্গিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পূর্ণোদ্দমে অপরাজেয় বাংলার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়। তবে অপরাজেয় বাংলার কাছে ভাস্করের নাম খচিত কোন শিলালিপি নেই। স্বাধীনতার এ প্রতীক তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন শিল্পী ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ৬ ফুট বেদীর উপর নির্মিত অপরাজেয় বাংলার উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে। এ ভাস্কর্যে সব শ্রেণীর যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে।
সাবাস বাংলাদেশ
দেশের অন্যতম বৃহৎ ভাস্কর্য ‘সাবাস বাংলাদেশ’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। এর স্থপতি শিল্পী নিতুন কুণ্ডু। এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকী ভাস্কর্য। ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ভাস্কর্যটি দাঁড়িয়ে আছে ৪০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে, যেখানে রয়েছে দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি। একজন রাইফেল উঁচু করে দাঁড়িয়ে আর তার বাঁ বাহুটি মুষ্টিবদ্ধ করে জাগানো। অন্যজন রাইফেল হাতে দৌড়ের ভঙ্গিতে রয়েছে; যার পরনে প্যান্ট, মাথায় এলোমেলো চুলের প্রাচুর্য যা কিনা আধুনিক সভ্যতার প্রতীক। এ দু’জন মুক্তিযোদ্ধার পেছনে ৩৬ ফুট উঁচু একটি দেয়ালও দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালের উপরের দিকে রয়েছে একটি শূন্য বৃত্ত, যা দেখতে সূর্যের মতোই। ভাস্কর্যটির নিচের দিকে ডান ও বাম উভয়পাশে ৬ ফুট বাই ৫ ফুট উঁচু দু’টি ভিন্ন চিত্র খোদাই করা হয়েছে। ডানদিকের দেয়ালে রয়েছে দু’জন যুবক-যুবতী। যুবকের কাঁধে রাইফেল, মুখে কালো দাড়ি, কোমরে গামছা বাঁধা, যেন বাউল। আর যুবতীর হাতে একতারা। গাছের নিচে মহিলা বাউলের ডান হাত বাউলের বুকে বাম দিকের দেয়ালে রয়েছে মায়ের কোলে শিশু, দু’জন যুবতী একজনের হাতে পতাকা। পতাকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গেঞ্জি পরা এক কিশোর। নির্মাণ কাজ শেষে হলে এর ফলক উন্মোচন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ভাস্কর্যে স্থান পেয়েছে তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার কয়েকটি লাইন। যা হলো: ‘সাবাস বাংলাদেশ/ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
সংশপ্তক
সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ নির্মিত হয়েছিল স্মারক ভাস্কর্য সংশপ্তক। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও লড়ে যান যে অকুতোভয় বীর সেই সংশপ্তক। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি। এর ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। মূল ভূমি থেকে ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১৫ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি। এছাড়া এটি নির্মাণে লাল সিরামিক ইট ব্যবহার করা হয়েছে।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পশ্চিম পাশে ডাসের পেছনে অবস্থিত এ ভাস্কর্য অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যোগায়। একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারের অত্যাচারের একটি খণ্ড-চিত্র। চৌকো বেদির ওপর মূল ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। উপরে বামে আছে মুক্তিযোদ্ধা কৃষক আর ডানে অস্ত্র হাতে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাঝখানে অস্ত্র হাতে নারী ও পুরুষ যোদ্ধারা উড়িয়েছে বিজয় নিশান। কিন্তু পতাকা ওড়ানোর জন্য বাঙালি যে রক্ত দিয়েছে, সয়েছে নির্যাতন, তার কটি খণ্ডচিত্র বেদির চারপাশে চিত্রায়িত। এ ভাস্কর্য বেদির বাম পাশে আছে ছাত্র-জনতার ওপর অত্যাচারের নির্মম চেহারা। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটির কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয়। এটি গড়েছেন অন্যতম কীর্তিমান ভাস্কর শামীম শিকদার।
বিজয় ‘৭১’
১৯৭১ সালের মহান মুক্তি সংগ্রামে বাংলার সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক হয়ে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘বিজয় ‘৭১’। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ‘বিজয় ‘৭১’। ভাস্কর্যে একজন নারী, একজন কৃষক ও একজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার নজরকাড়া ভঙ্গিমা বার বার মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে নিয়ে যায় দর্শনার্থীদের। একজন কৃষক মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেছে আকাশের দিকে। তার ডান পাশেই শাশ্বত বাংলার সর্বস্ব ত্যাগী ও সংগ্রামী নারী দৃঢ়চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন। যার সঙ্গে আছে রাইফেল। অন্যদিকে একজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গিমায় বাম হাতে রাইফেল নিয়ে তেজোদীপ্তচিত্তে দাঁড়িয়ে। বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী শ্যামল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ‘বিজয় ‘৭১’ ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ ২০০০ সালের জুন মাসে শেষ হয়।
চেতনা ‘৭১’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য চেতনা ‘৭১’। এই ভাস্কর্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এবং একাডেমিক ভবন গুলোর লাল ইটের সাথে মিল রেখে ভিত্তি বেদির ৩ টি ধাপ বানানো হয়েছে লাল ও কালো সিরামিক ইট দিয়ে। এর মধ্যে নিচের ধাপের ব্যাস ১৫ ফুট, মাঝের ধাপ সাড়ে ১৩ ফুট এবং উপরের ধাপ ১২ ফুট। প্রত্যেকটি ধাপ ১০ ইঞ্চি করে উঁচু। বেদির ধাপ ৩টির উপরে মুল বেদিটি ৪ ফুট উঁচু, তার উপরে ৮ ফুট উঁচু মূল ফিগার। ভাস্কর্যের নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ সম্পন্ন করেন শিল্পী মোবারক হোসেন নৃপাল। ভাস্কর্যটিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উচ্চে তুলে ধরার ভঙ্গিমায় একজন ছাত্র এবং সংবিধানের প্রতীকী বই হাতে একজন ছাত্রী রয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে ভাস্কর্যটি নির্ভীক প্রহরীর মত স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
অদম্য বাংলা
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এই ভাস্কর্যটির স্থপতি শিল্পী গোপাল চন্দ্র পাল। ২০১১ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তা শেষ হয়। আধুনিক দৃষ্টিনন্দন ২৩ ফুট উচ্চতার মুক্তিযুদ্ধের এ ভাস্কর্যটির মূল অংশে স্থাপিত হয়েছে একজন নারীসহ বলিষ্ঠ ও তেজোদৃপ্ত চার মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি, যা বাঙালি জাতির শৌর্য-বীর্যের মূর্ত প্রতীক। ভাস্কর্যটি মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের তথা নারী-পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্মিলিত ভূমিকার প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। বেদির চারদিকের ম্যুরালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি, বধ্যভূমির বর্বরতা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র পোড়া মাটির ফলকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বীরের প্রত্যাবর্তন
মোজাম্মেল হক বীরপ্রতীকের উদ্যোগে স্থাপিত এই ভাস্কর্যটি গুলশান দুই নম্বর ঘেঁষে ভাটারা ইউনিয়নে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বউত্তর-পূর্ব কোণে ফাজিলারটেক শাওড়াতলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর্যটির বেদির উচ্চতা ৪১ ফুট। বেদির চারপাশে পোড়ামাটির ফলকে তুলে ধরা হয়েছে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, ১৯৪৮ সালের দেশ বিভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। উঁচু বেদির ওপর স্থাপিত রয়েছে এক মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব। ২৮ ফুট উঁচু এ যোদ্ধা বিজয় ছিনিয়ে অস্ত্র কাঁধে বীরের বেশে ফিরছেন। বেদির নিচে ভাস্কর্যের বাকি অংশ গাছের গুঁড়ির আকার নিয়েছে। ভাস্কর্যটির নিচে আছে একটি পাঠাগার। মুক্তিযুদ্ধের বই দিয়ে সাজানো সেটি। চারপাশের দেয়ালে লাগানো যুদ্ধকালের পত্রপত্রিকা। এ ভাস্কর্য ঢাকার মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের মধ্যে সর্বোচ্চ। ‘বীরের প্রত্যাবর্তন’ ২০০৮ সালের ২৯ মার্চ উদ্বোধন করেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।
Leave a Reply