স্বস্ধ্যসেবাই ‘কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী’
বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবা এখন বিশ্বে রোল মডেল। গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির কয়েকটি সূচকে ভারত, পাকিস্তানসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েছে এবং ক্রমে আরও হ্রাস পাচ্ছে। প্রসূতিসেবার মান বৃদ্ধির ফলে প্রসবকালে তাঁদের মৃত্যুর ঝুঁকিও কমেছে। টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের ফলে কিছু সংক্রামক রোগ, যেমন পোলিও নির্মূল হয়েছে এবং যক্ষ্মা, কলেরা ইত্যাদি রোগে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সারা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কর্মরত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা সাধারণ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), কমিউনিটি প্যারামেডিক, উপসহকারী স্বাস্থ্য সহকারী(SACMO) অথবা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস্ বিশ্বাস।
তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে ১৩,৪৫০টি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রায় ৫ কোটিরও বেশি মানুষকে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। এসব ক্লিনিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নিরলসভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীরা।
কাজের সুযোগ
অফিস এবং দায়িত্ব আনুযায়ী কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের সাধারণ পদবী আলাদা হয়ে থাকে। যেমন: কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), কমিউনিটি প্যারামেডিক, উপসহকারী স্বাস্থ্য সহকারী(SACMO), পরিবার পরিকল্পনা সহকারী। একজন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করেন। তবে স্বাস্থ্য সহকারী জেলা সিভিল সার্জন এর কার্যালয়ের অধীনে আর পরিবার পরিকল্পনা সহকারী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের অধীনস্ত হলেও তারা অস্থায়ীভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করে থাকেন। কমিউনিটি প্যারা মেডিকরা সাধারণত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মাতৃ ও শিশু কল্যাণ হাসপাতালে কাজ করে থাকে। এছাড়া গ্রামে এনজিওগুলোর চিকিৎসা কেন্দ্রেও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীরা কাজ করেন।
দায়িত্ব
শিশুদের টিকা দেওয়া, গর্ভকালে ও প্রসবের সময় প্রসূতি ও শিশুর সেবা, কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া; ডায়রিয়া, কলেরা, কালাজ্বর ইত্যাদি প্রতিরোধ, নির্মূল করাসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীরা দিয়ে থাকেন। দেশের জনগোষ্ঠীর একদম তৃণমূল পর্যায়ে তাঁদের আট ধরনের স্বাস্থ্যসেবার কার্যকারিতা ও সাফল্য বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও প্রশংসিত হয়েছে।
কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীরা সাধারণত ঠাণ্ডা, জ্বর, ডায়রিয়ার মত সাধারণ অসুখের জন্য ঔষধ প্রদান করে থাকে;
রোগীর অবস্থা বেগতিক বুঝলে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেলা সদর হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করে;
অনেক কমিউনিটি ক্লিনিকে নবজাতকের স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে মহিলা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের এর উপরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে;
টিকা দান, পরিবার পরিকল্পনা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ ও সেবা দিয়ে থাকে কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীরা;
স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের পাশাপাশি কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীদের ক্লিনিকে আসা রোগীদের নাম ও বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে হয়;
কমিউনিটি প্যারামেডিক ও স্বাস্থ্য সহকারী ঔষধ প্রদানের পাশাপাশি কাটা-ছেঁড়া কিংবা কোথাও ভেঙ্গে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন;
বিশেষ প্রয়োজনে অনেক স্বাস্থ্যকর্মীকে রোগীর বাড়ি যেয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে;
প্রয়োজনীয় ঔষধ শেষ হয়ে গেলে অনেক সময় জেলা সদর থেকে ঔষধ নিয়ে আসার কাজ করতে হয়।
যোগ্যতা
কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মী হতে হলে উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষা পাশ হতে হবে। এর পর নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তির্ণ হলে তাকে যথাযথ পরিক্ষণ দেওয়া হয়। উপসহকারী স্বাস্থ্য সহকারী হতে হলে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর সরকারি অনুমোদিত যেকোন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল(MATS) থেকে ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি (DMF) ডিগ্রী নিতে হবে। পরিবারপরিকল্পনা সহকারীদের ক্ষেত্রে এসএসসি/এইচএসসি তে কমপক্ষে একটি দ্বিতীয় বিভাগ সহ এইচএসসি পাশ হতে হবে। কমিউনিটি প্যারামেডিকদের ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (IHT) থেকে কমপক্ষে ২ বছরের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।
দক্ষতা ও জ্ঞান
একজন কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীকে অবশ্যই সাধারণ রোগের ঔষধ সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে;
জ্বর, ডায়রিয়া, ঠাণ্ডা-কাশির মত রোগ সম্পর্কে জানতে হবে যেন এসব রোগ প্রকোপ আকার ধারন করলে লক্ষণ দেখে বোঝা যায়;
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞান রাখতে হবে;
প্রসব, কাটা- ছেড়ার সেলাই, ভেঙ্গে গেলে প্রাথমিক ব্যান্ডেজ সহ অন্যান্য প্রয়াথমিক চিকিৎসা করতে দক্ষ হতে হবে;
ক্লিনিকে আগত রোগীদের তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং কম্পিউটার চালনায় দক্ষ হতে হবে;
ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে;
টিকাদান কর্মসূচি, জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী পরিচালনা করার দক্ষতা থাকতে হবে।
প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনা
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডের স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৩ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত মোট ১০৩৫৩ জন কর্মীকে বেসিক ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। ১৫১৭ জন মহিলা কর্মীকে প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বেসিক ট্রেনিং ছাড়া আরো অনেক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে থাকে স্বাস্থ্য বিভাগ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের অধীনে ৮ টি সরকারি ও ১৭৩ টি বেসরকারি মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (MATS) ও ৪৩ টি বেসরকারি ইন্সটিটিউট অব হেলথ ট্রেনিং আছে। এগুলো থেকে ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ডিগ্রী দেওয়া হয়। এই কোর্সে ভর্তির জন্য বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করা বাধ্যতামূলক।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (নিপোর্ট) সরকারিভাবে ২০১১ সালে ২ বছর মেয়াদি কমিউনিটি প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে। বর্তমানে দেশে মোট ২৭ টি ইন্সটিটিউট থেকে কমিউনিটি প্যারামেডিক কোর্স করানো হয়
ক্যারিয়ার গ্রাফ
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার(সিএইচসিপি) দের চাকুরী কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার প্রোজেক্টের আওতাধীন । এ চাকুরী সরকারীকরণ না করা হলেও সরকার দ্রুত কমিউনিটি ট্রাস্ট গঠন করে সিএইচসিপি দের চাকুরী ট্রাস্ট এর আওতাধীন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারী বা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পদে স্থায়ী অস্থায়ী দুইভাবেই নিয়োগ দেওয়া হয়। স্থায়ী নিয়োগে সরকারি চাকুরীর সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। কমিউনিটি প্যারামেডিকদের ক্ষেত্রে দক্ষ ও যোগ্য হলে দেশী-বিদেশী এনজিতে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়। সেইভ দ্যা চিলড্রেন, মেরি স্টেপস এর মত অসংখ্য এনজিও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট আর কমিউনিটি প্যারামেডিকদের বিদেশেও যথেষ্ট চাহিদা আছে। এজন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে হবে।
Leave a Reply