শেষ অভিভাষণ: খোদা-ই-খিদমতগার – মওলানা ভাসানী

(১৯৭৬ সালের ১৩ নভেম্বর শেষবারের এতো মওলানা ভাসানী সন্তোষে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে। সন্তোষে তিনি এ দিন ‘খোদা-ই খিদমতগার’-এর এক অধিবেশনে ভাষণ দেন। এটিই তাঁর শেষ ভাষণ। ওই দিনই তিনি হাসপাতালে চলে যান এবং ১৭ নভেম্বর বুধবার রাত প্রায় সাড়ে আটটায় তিনি পরলোকগমন করেন।)

আমার জীবনে শতাব্দী পূর্তির আর অধিক বাকি নাই। বার্ধক্য ও দীর্ঘ অসুস্থতা মাথায় লইয়া হয়ত-বা শেষবারের এতো খানায়ে ক’বার তওয়াফ ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মজার শরিফ জিয়ারতের নিয়ত করিয়াছি। আপনাদের সকলের দোয়ার বরকতে আল্লাহ্ আমার এই ওয়াদা পূরণ করিবেন এই উমেদ রাখি। যাইবার প্রাক্কালে সকলের নিকট হইতে দোয়া ও মা’ফি চাহিয়া নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে আপনাদিগকে দাওয়াত করিয়াছি। কারণ এই বৃদ্ধ বয়সে সকলের বাড়ি যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। কোনো পাওনাদেনা থাকিলে চাহিয়া নিবেন অথবা আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করিয়া দিবেন। কাহাকেও কোনো কষ্ট দিয়া থাকিলে মনে রাখিবেন না।
অন্যায়ের প্রতি অনীহা আমাকে সারা জীবন বিভিন্নমুখি কর্মতৎপরতায় প্রেরণা জোগাইয়াছে। এই স্বভাবজাত প্রবণতার সহিত যোগ হইয়াছে আসামের জলেশ্বরের সুফি সাধক হযরত শাহ নাসিরুদ্দিন বোগদাদির অধ্যাত্ম শিক্ষা। আরো যোগ হইয়াছে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধাপে, ধাপে খেলাফত আন্দোলন, পাকিস্তান যুগে ভাষা-আন্দোলন-এই সবই আমি ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রবিন্দু হইতে অবলোকন করিয়াছি।
বাংলাদেশ যুগে আমার মর্মভেদী অভিজ্ঞতা হইয়াছে। কেমন করিয়া রক্তের সাগর সাঁতরাইয়া এবং আগুনের পাহাড় ডিঙাইয়া স্বাধীনতা লাভ করিয়া একটি জাতি ক্ষমতালিদু দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্বের দোষে মাত্র তিন বছরের মধ্যে দুঃখ ও দুর্দশার অতলে তলাইয়া যায়। এই অভিজ্ঞতা আমার চিন্তা ও চেতনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখিয়া গিয়াছে। আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিয়াছি, আদর্শবোধবর্জিত শ্লোগানধর্মী ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করিতে পারে না। গভীর আদর্শবোধসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রবান এবং আপোসহীন সংগ্রামশীলতার অধিকারী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরাই মানুষের সার্বিক কল্যাণের পথ সুগম করিতে পারেন। চরিত্র গড়িয়া ওঠে আদর্শ চেতনা ও আদর্শ অনুশীলনের মাধ্যমে। একমাত্র আদর্শভিত্তিক সংগঠন ও কর্মসূচির মাধ্যমেই চরিত্রবান নেতৃত্ব ও কর্মী সৃষ্টি হইতে পারে। মুহূর্তের উত্তেজনায় মানুষ চরম আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শক হাতের মুঠায় পাইয়া তাহারাই শুধু ন্যায়পরায়ণতা ও সাধুতার পথে অটল থাকিতে পারিবে যাহারা সঠিক আদর্শবোধ ও উহার দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে মহৎ চরিত্রের অধিকারী হইতে পারিয়াছে।
আমার বিগত ৭৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার হাতবদল কখনো-বা অতি নিকট হইতে, কখনো-বা কিঞ্চিৎ দূর হইতে অবলোকন করিয়াছি। এই পর্যায়ক্রমিক পট পরিবর্তনের ধারায় আমি নিজেও সাধ্যএতো সক্রিয়তা বজায় রাখিয়াছি। কিন্তু যে কৃষক-মজুর-কামার-কুমার-জেলে-তাঁতি-মেথর প্রভৃতি মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন আবাল্য দেখিয়াছি ও সেজন্য সংগ্রাম করিয়াছি, তাহা আজও সুদূরপরাহত রহিয়া গিয়াছে। তাই আমার সংগ্রামের শেষ নাই। এই সংগ্রাম আজীবন চলিবে। আমার মৃত্যুর পর এই সংগ্রামের উত্তরাধিকার তাহাদের উপর বর্তাইবে যাহারা এক আল্লাকে প্রভু জানিয়া এবং একমাত্র তাঁহারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থভাবে খেদমতে-খালক অর্থাৎ মানবজাতি তথা সমগ্র সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করিবে। জীবনসায়াহ্নে উপনীত হইয়া খোদা-ইখিদমতগার সংগঠন গড়িয়া তোলার পটভূমিকা ইহাই। খোদা-ই-খেদমতগাররা জাতি-ধর্ম-নবীর আহসাবে সুফফার জীবনই হইবে তাহাদের আদর্শ। ক্ষমতারদ্বন্দ্ব এবং জাগতিক দেনা-পাওনাকে তাহারা এড়াইয়া চলিবে ঘৃণাভরে। মানুষের শাসনবাদকে উৎখাত করিয়া আল্লাহর শাসনবাদ কায়েম করাই হইবে খোদা-ই-খিদমতগারদের লক্ষ। ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনীতি তাহারা সর্বাবস্থায় পরিহার করিয়া চলিবে। সেবা ও সংগ্রামের পথই খোদা-ই-খিদমতগারদের পথে। হক্কুল-এবাদ আদায় করাই হইবে তাহাদের সকল কর্মপ্রয়াসের মূলমন্ত্র এবং ইহাই আমার রাজনীতিসহ সকল কর্মকাণ্ডের ভিত্তিমূল।

বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়, সারা দুনিয়া আজ কতিপয় পরস্পরবিরোধী জোটে বিভক্ত। ফলে বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক সভ্যতাগর্বিত মানুষ পরস্পর নিধনের মতলবে বিরামহীন মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ইহারই পরিণতিতে সমগ্র পৃথিবী একটি মারাত্মক অস্ত্রাগারে পরিণত হইতে চলিয়াছে। ছোট-বড়, গরিব-ধনী সকল রাষ্ট্রই এই আত্মঘাতী মাতলামিতে নিমগ্ন। অথচ আজও বিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ নিদারুণ দারিদ্রদ্র্যকবলিত। এবং এই বিশ্বগ্রাসী সমস্যা ও সঙ্কটের উৎসমূল হইল সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহযোগিতা জোরদার করিয়া সকলে সার্বজনীন কল্যাণ প্রয়াসে আত্মনিয়োগ করিলে অভাবিতরূপ অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বুক হইতে দুঃখ-দারিদ্রদ্র্য মুছিয়া ফেলা যাইবে। কিন্তু এই আশা ততদিন পর্যন্ত দুরাশাই থাকিয়া যাইবে, যতদিন না মানবজাতি এক আল্লাহর প্রভুত্ব এবং দুনিয়ার সম্পদে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার স্বীকার করিয়া লইবে। পারস্পরিক পালনবাদী সম্পর্কই হইবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভিত্তি। ইহারই নাম রব্বানি আন্তর্জাতিকতাবাদ। এই দিক হইতে নবজাগ্রত মুসলিম বিশ্বেরও সবিশেষ দায়িত্ব রহিয়াছে। নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা সুদৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করাইয়া তাহাদিগকে তৃতীয় বিশ্বের অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করিতে হইবে। তাহাদিগকেই হইতে হইবে রব্বানি আস্ত জাতিকতাবাদের ধারক ও বাহক। আন্তর্জাতিক পরিসরে এই আদর্শের প্রচার ও প্রসার সাধন করাই খোদা-ই-খিদমতগারের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

বাংলাদেশ আজ এক যুগসন্ধিক্ষণে। এদেশের মানুষ ক্ষমতালিদু দুর্নীতিপরায়ণ, শূন্যগর্ভ, প্রতিশ্রুতিসর্বস্ব ভাঁওতাবাজ রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। তাহারা কোনো অবস্থাতেই বলগাহীন দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার এবং সর্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতার রাজত্বে ফিরিয়া যাইতে চাহে না। সাদা-কাপড়ী দালানবাসী মানুষ, কলের মানুষ খালবিল আর নদীনালার মানুষের রাজ কায়েম করিতে হইবে। ইহারাই এই দেশের শতকরা ৮৫ জন। উৎপাদনশীল গঠনমূলক কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে ইহাদিগকে সংগঠিত করিয়া তাহাদের মধ্যে সংগ্রামী ও পালনবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাইতে হইবে। শ্রমজীবী মানুষের হাতে নেতৃত্ব না আসা পর্যন্ত হঠকারী ও শোষণের রাজনীতির অবলুপ্তি ঘটিবে না। বর্তমান মুহূর্তে গণদুশমনেরা ক্ষমতাচ্যুত। কল্যাণমুখী জাতিগঠনমূলক কর্মপ্রয়াসের প্রবণতা সর্বত্র পরিলক্ষিত হইতেছে। ইহাতে দেশি-বিদেশি শোষক-জালেমেরা অস্থির হইয়া শতবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছে। এমতাবস্থায় সকলের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের তাহজীব-তমদ্দুনবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়িয়া তোলা। খোদা-ই-খিদমতগারেরা এই লক্ষে নিরলস সংগ্রাম করিয়া যাইবে।
স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে চার বছর যাবৎ ক্ষমতাসীন দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ও অরাজকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্দ্রে প্রবিষ্ট করানো হইয়াছে। দেশের উচ্চতম বিদ্যাপীঠ, বিচারালয় ও প্রশাসনযন্ত্র হইতে শুরু করিয়া নিম্নতম ধাপ পর্যন্ত দুর্নীতি কলঙ্ককজনকভাবে বদ্ধমূল হইয়া আছে। ফলে নিদারুণ নৈতিক অবক্ষয় সমগ্র সমাজকে গ্রাস করিয়া চলিয়াছে। দুর্নীতির রাজত্বে দারিদ্র্য দুঃখ- হানাহানি বাড়িবে বৈ কমিবে না। তাই সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার সংগ্রামে খোদ- ই-খিদমতগাররা সর্বশক্তিতে ঝাঁপাইয়া পড়িবে।
উৎপাদনশীল কর্মপ্রয়াস শুধুমাত্র সরকারি তত্ত্বাবধানে চলিতে থাকিলে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা নাই। জনগণকেই নিজেদের ভাগ্য জনগণের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ সাধন করিতে হইবে। স্বেচ্ছাশ্রম এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখিবে। জনগণের এই উদ্দেশ্যে উদ্বুদ্ধ এবং সংগঠিত ও সক্রিয় করিয়া তোলা খোদা-ই-খিদমতগারদের অন্যতম কর্তব্য।
অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার শোষণ-জুলুমের সহায়ক। অজ্ঞতাই বিভেদ- মানসিকতার জন্ম দেয়। জ্ঞানের অভাবই মানুষে মানুষে বৈরিতা ও হিংসার উৎস। দিকে দিকে জ্ঞানের আলো জ্বালাইয়া তুলিতে হইবে। চিন্তা ও কর্মের উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে হইবে। সেবাই পরম ধর্ম তৈয়ার করার লক্ষেই আমি এই ইতিহাসবিশ্রুত খোশনদপুরে (সন্তোষে) হযরত পির শাহ জামান কাশ্মীরীর (র.) মিশনের পুনরুজ্জীবন ঘটাইয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছি। তাই জাতি-ধর্ম-দল-মতনির্বিশেষে সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের প্রতি আমার আবেদন, আপনারা খোদার ওয়াস্তে সংগ্রামে আগাইয়া আসুন। রবুবিয়াতের পথই অর্থাৎ সার্বজনীন মানবাধিকার ও সামগ্রিক কল্যাণের পথই সাফল্য ও শান্তির পথ। আল্লাহর শত্রু অর্থাৎ শোষক, জালিম, মুনাফাখোর ও চোরাকারবারী, দুর্নীতিবাজ ও দুষ্কৃতকারীদের দুশমন জানুন। আল্লাহর দোস্ত অর্থাৎ যাহারা সৎভাবে জীবনযাপন করে, হালাল রোজগার করে, হক-কথা বল, শোষিত বঞ্চিতের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানিয়া চলে, তাহাদিগকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করুন। আল্লাহর দোস্ত আমাদের দোস্ত, আল্লাহর দুশমন আমাদের দুশমন। তাহা হইলে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী জানিবেন।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *