রবুবিয়তের ভূমিকা – মওলানা ভাসানী

সে ১৯৪৬ সালের কথা। রাত তখন বারোটা। বিপ্লবী দার্শনিক আল্লামা আজাদ সোবহানী দুবড়ীর (আসাম) একটি ঘরে বসিয়া একটার পর একটা সিগারেট টানিতেছেন। আমি নিশ্চুপ হইয়া তাঁহারই সামনে বসিয়া রহিয়াছি। হঠাৎ তিনি আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিলেন ও আমার ডান হাতখানা সিগারেটের ছাই ফেলার পাত্রটির উপর রাখিয়া বলিলেন, মনে কর ইহাই কাবাঘর। আমি তো চমকিয়া উঠিলাম। কিন্তু এই দার্শনিকের উন্মাদনা আমার জানা ছিল। তাই বলিলাম, হ্যাঁ ইহাই কাবাঘর। আল্লামা বলিলেন, তবে আজ ওয়াদা করো তুমি রাজনৈতিক জীবনে যত কলাকৌশলই নাও না কেন মূলত হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের লক্ষে সংগ্রাম করিয়া যাইবা। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়িল ১৯৩৫ সালে আমরুহাতে ১৭ জন আলেম রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্তের কথা। মনে পড়িল মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা ওবায়দুল্লা সিন্ধী প্রমুখের সাথে আমার যোগাযোগ ও ওয়াদার কথা। আমার মনে পড়িল খিলাফত আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর সাহচর্যের কথ্য। আমি দেখিলাম যৌবনের উচ্ছ্বাস শেষে যে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়াছিলাম আজ প্রৌঢ় জীবনে সেই রাজনৈতিক দর্শনের দাওয়াতই আসিয়াছে। আমি তাই ইতস্তত করিলাম না। মওলানা আজাদ সোবহানীর হাতের উপর আমার হাত ছিল। তাঁর কল্পনায় আমাদের হাত কাবাতে নিবদ্ধ ছিল। আমি বলিলাম, হ্যাঁ ওয়াদা করিলাম, রাজনীতিতে যাহা কিছুই করি হুকুমতে রব্বানিয়া হইতে লক্ষ্যাচ্যুত হইব না।
দীর্ঘ ২৭টি বছর কাটিয়া গিয়াছে। আজ আমি ব্যাখ্যা করিয়া বালেতে চাই না কিভাবে আমি ধাপে ধাপে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের পথে চলিয়া আসিয়াছি। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কোনো ভাষ্যকার যদি আবিষ্কার করিতে পারেন, তবে দেখিবেন ১৯২১ সাল হইতে আমি এই পথ ধরিয়াছি। কখনো কোথাও আমি কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছি। কোথাও আবার নেতৃত্ব দান করিয়াছি। আজ আমি পুরস্কার ভঙ্গিমায় শুরু করিয়াছি। হুকমুতে রাব্বানিয়া কায়েমের প্রস্তুতি তাই গত ৮ এপ্রিল (১৯৭৪) সন্তোষে হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। সবারই মনে প্রশ্ন জাগে, এতদিনে কেন? আমি বিশ্বাস করি, সব কথা ও কাজের একটি মওসুম আছে। যদি তাহা মওসুমমাফিক মানুষের নিকট পেশ না করা যায় তবে অতীব কল্যাণকর বিষয়ও অর্থহীন এবং গুরুত্বহীন হইয়া পড়ে। হযরত গাজ্জালী (র.) বলিয়াছেন, যদি কোথাও আজান দ্বারা মানুষকে নামাজের দিকে না আনা যায় তবে ঢোল-শহরতই বাজাও। বাংলাদেশের মানুষ বহুত ঘুমাইয়াছে। এতদিন ঢোল- শহরতে ঘুম ভাঙ্গিত। আজ আজানেই ভাঙিবার অভ্যাস হইয়াছ। তাই আমি হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আহ্বান জানাইতেছি-আসসালাতু খাইরুম মিনান-নাউম।
দ্বিতীয়ত: আমি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি, যত সরকারই বদল করি না কেন কোনো ফলোদয় হইবে না যদি না শাসকবর্গ চরিত্রবান হয়। শাসক চরিত্রবান হইলে গোটা সমাজটাই কল্যাণময় পূতপবিত্র পরিবেশের দিকে ধাবিত হয়। আর চরিত্রবান লোকেরাই কেবল আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করিতে পারে। আমি তাই হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতির আশ্রয় লইয়াছি। দোয়া করি, আল্লাহর মরজি হউক, এই সমিতির জরিয়তে বিশ্বমানবতার জয় হউক।
তৃতীয়ত: আমি দেখিতে পাইতেছি নানা মতবাদ নানা পন্থা মানুষকে নতুন নতুন শ্রেণিতে বিভক্ত করিয়া ফেলিয়াছে। শ্রেণিহীন সমাজের কথা ভাবিতে গিয়া মানুষ আত্মকেন্দ্রিক ও হিংস্র হইয়া পড়িয়াছে। আমার বিশ্বাস একমাত্র রবুবিয়তের দর্শনই জাতি, ধর্ম, মতবাদ নির্বিশেষে শান্তি দিতে পারে। সবারই লক্ষ্য যদি স্রষ্টা অবকাশ কোথায়? স্রষ্টার নিকট তো সবাই সমান। তিনি একই বিধানে সকলের নিকট দাতা, দয়াময়, প্রেরণাদানকারী-এক কথায় সকল চেতনার উৎস। আজ দুনিয়া হইতে অশান্তি দূর করিবার বাস্তব কর্মসূচি পেশ করিতে আমি হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। কে বলিতে পারে, আল্লাহর মরজি আছে কিনা রবুবিয়তের আদর্শ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানই বিশ্বশান্তি কায়েমে নেতৃত্ব দান করিবে অথবা দৃষ্টান্ত স্থাপন করিবে।
হুকুমতে রব্বানিয়ার মূলকথা-আল্লাহর দোস্ত আমাদের দোস্ত, আল্লাহর দুশমন আমাদের দুশমন। এই সমিতি সমাজতন্ত্রবাদীদের এতো কেবল লা ইলাহা- ই কায়েম করিবে না, সেখানে ইল্লাল্লাহর বীজও বপন করিবে। তাহাদের কোনো কাজে আত্মতুষ্টি অর্থাৎ নফসাণিযাত যেমন থাকিবে না ঠিক তেমনি আদায় করিবে তেমনি হককুল এবাদও করিয়া যাইবে। স্রষ্টাকে ভালোবাসিয়া সৃষ্টির কল্যাণ সাধন করিয়া তাহারা রবের ঐশী পালনবাদকে পার্থিব ভঙ্গিমা দান করিবে। তাই এই সমিতি মানুষের যেমন বৈষয়িক উন্নতি ঘটাইবে, সঙ্গে সঙ্গে তেমনি আত্মিক শক্তির বিকাশও ঘটাইবে। তাহারা একইসঙ্গে জাহের ও বাতেনের সামঞ্জস্য ঘটাইয়া জীবনকে প্রাণময় করিয়া তুলিবে একইসঙ্গে জাহের ও সালেকের রূপ-রস লাভ করিয়া আবাদিয়াতের হক পূর্ণ করিবে। আল্লাহর পবিত্র কোরআন বলিয়াছে, “আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদিগের মধ্যে কোনো কিছুই ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করি নাই-আমি এই দুইটি অযথা সৃষ্টি করি নাই; কিন্তু উহাদিগের অধিকাংশই ইহা জানে না (সুরা দুখান)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির যথার্থতা সম্পর্কে বলিয়াছেন। কোনোকিছুর তামাশা কিংবা খামখেয়ালীর বশে সৃষ্টি করা হয় নাই। তাই কোনোকিছুর সৃষ্টিই অহেতুক নহে, সকল কিছুর অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিষয় বিশেষে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘রব’ গুণে গুণান্বিত হইয়া শুধু সবকিছুর সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না সবকিছুকে বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন-পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই পালনবাদের আদর্শই হইল রবুবিয়ত। সকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় রবুবিয়তের আদর্শ যে-রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হইবে তাহাই হুকুমতে রব্বানিয়া। সে-রাষ্ট্রে থাকিবে স্রষ্টার পালনবাদ-মানুষের শাসনবাদ নহে। আজকের দুনিয়ায় রাজনৈতিক সকল মতবাদ মানুষের নিজস্ব শাসন আরোপ করিয়াছে। যাহা এক কথায় হইয়াছে নফসানিয়াত, যাহার দরুন প্রকৃতপক্ষে পালনবাদের স্থলে কায়েম হইয়াছে শাসনবাদ। তাই দেখা যাইতেছে ধনবাদী হউক আর সমাজবাদীই হউক কোনো ব্লকের মানুষই সুখী হইতে পারে নাই, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয় নাই। ধনবাদী সমাজের শাসন ও শোষণ মানবজাতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলিয়া দিতেছে। তথাকথিত সমাজবাদী দুনিয়ার শাসন ও সঙ্কোচন মানুষকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিয়াছে। সেখানে আত্মিক বিকাশের কোনো মুক্ত পথ কিংবা অনুমতি নাই।
সকল সমস্যার সমাধান হইবে মানবজাতি যদি রবুবিয়তের অর্থাৎ স্রষ্টার পালনবাদের আদর্শে হুকুমত কায়েম করিতে পারে। শিক্ষা-দীক্ষা, খাওয়াপরা ইত্যাদির প্রশ্নে স্রষ্টার নিকট যেমন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি পরিচয়ের কোনো বালাই নাই মানুষের দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার ক্ষেত্রে যেমন ভেদাভেদ নাই ঠিক তেমনি হুকুমতে রব্বানিয়ায় সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার দেওয়া হইবে। আজ আর কোনো সন্দেহ নাই-একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে শাসন, শোষণ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া মানবজাতিকে সুখী করিতে পারে।
আমি যখন হুকুমতে রব্বানিয়ার কথা বলি তখন শুধু কমিউনিস্ট ও বামপন্থি রাজনীতিবিদরাই বিরোধিতা করেন না, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থি একশ্রেণির আলেমওলামা এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদও প্রচণ্ড আপত্তি উত্থাপন করেন। আমি বলিয়া থাকি, সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ উহার আমানতদার মাত্র। তাই আল্লাহর নামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে বণ্টন করিয়া ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করিতে হইবে। কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন বটে কিন্তু তাহাদের মতে উহা আল্লাহর নামে না হইয়া রাষ্ট্রের নামে হইতে হইবে। আলেমওলামারা সব কিছুতে আল্লাহর মালিকানা মানিয়া লইয়া থাকেন বটে কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন না। এইভাবে হুকুমতে রব্বানিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী দুইটি মতবাদ রহিয়াছে, ইহা আমার অনুসারীদিগকে বুঝিয়া লইতে হইবে। তন্মধ্যে কমিউনিস্টদের বস্তুসর্বস্ব চিন্তাধারা সম্পর্কে মানবজাতি বিশেষ করিয়া মুসলিমজাহান হতাশ হইয়া পড়িয়াছে।
এই পার্থিব জীবনে খাওয়াপরার সংস্থানের পরও মানুষের অপর একটি চাহিদা থাকিয়া যায়। তাহা হইল আধ্যাত্মিক উপলব্ধি। উহা সংসার জীবনের সুখ- দুঃখ, ভালোবাসা, সৃষ্টিজগতের রহস্য, সামাজিক পারিবারিক বন্ধন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিরাজ করিতেছে। কমিউনিস্টরা অদৃশ্য ও ভাবমূলক জীবনবোধের ধার ধারে না। তাই তাহারা মানুষের সামগ্রিক চাহিদা পূরণ করিতে পারে নাই। আল্লাহর নামে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করিলে যেমন পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আসিবে তেমনি আধ্যাত্মিক উপলব্ধিরও একটি যোগসূত্র কায়েম থাকিবে। আফসোসের বিষয়, এক শ্রেণির আলেমওলামা ইহা মানিয়া লইতে চান না: হুকুমতে রব্বানিয়ার কথা বলিলে তাহারা নাখোশ হইয়া ওঠেন। আবার শেখ মুজিবের ভাঁওতাবাজির সমাজতন্ত্র, মোনাফেকীর ধর্মনিরপেক্ষতা ঠেকাইয়া রাখিতে না পারিয়া পরোক্ষভাবে স্বীকার করিয়ে লইয়াছেন। তাই বলিয়া আমি হাল ছাড়িয়া দিতে পারি না। উহাতে আমার কোনোপ্রকার খোদপছন্দী নাই। আমি চাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েম করিয়া হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব চাহিদা পূরণ করিতে। ইহার সাথে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নাই। তাই সকল ধর্মাবলম্বী উহার উপকারিতা ভোগ করিতে পারিবে। নিজ নিজ ধর্মীয় দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটিবে ইহাই আমার কামনা।
যে-কেউ প্রশ্ন করিতে পারেন হুকুমতে রব্বানিয়া কীভাবে অমুসলমানদেরকে আপন করিয়া লইবে? যাহারা রবুবিয়তের মর্ম বুঝেন না তাহাদের এই প্রশ্ন করা খুবই স্বাভাবিক। রবুবিয়ত কোনো ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল মানুষের জন্য হুকুমতে রব্বানিয়া অর্থাৎ যে-দেশে রবুবিয়তের আদর্শ রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে কায়েম হইয়াছে কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। মুসলমানদের জন্য যিনি রব বা পালনকর্তা, বিবর্তনকারী প্রভু, হিন্দুর জন্য তিনি একই বিধানে আলো-হাওয়া, ফল, পানি, বস্ত্র, খাদ্য সবই জোগাইতেছেন। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে। রবুবিয়তের আদর্শকে নফসানিয়াত অর্থাৎ আমার নিমিত্তে, আমার উদ্দেশ্য, আমার লক্ষ্য ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, চিন্তাধারা লুপ্ত করিয়া ফেলে। আলেমওলামারা ও কমিউনিস্টরা দুই দিক হইতে জীবনের একই ব্যাখ্যা করিয়া বসেন যা সূক্ষ্ম ও সঠিক দৃষ্টিতে নফসানিয়াতেরই নামান্তর। তাই নফসানিয়াত কখনো জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমভাবে কল্যাণসাধন করিতে পারে না, পারিবে শুধু রবুবিয়ত বা পালনবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সকল সমস্যার সমাধান।
আল্লাহর কাছে আমার একটিই মুনাজাত-হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতিকে তোমার রহমতের দরওয়াজা হইত ফিরাইয়া দিও না, নিজ গুণে কবুল করিয়া নাও।
(প্রকাশ: সন্তোষ, মে ১৯৭৪)


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *