ফার্নিচার শিল্প
দেশীয় ফার্নিচার শিল্প ক্রমশই সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে। এক সময় আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হলেও এখন ঘটছে তার উল্টো। দেশীয় চাহিদার পূরণের পর রফতানি হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ফার্নিচার রফতানি বেড়েছে ১২ গুণেরও বেশি। ফার্নিচার শিল্প এখন দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত। সম্ভাবনাময় এই খাত নিয়ে
ফার্নিচার শিল্প কি?
ফার্নিচার বা আসবাবপত্র বলতে এক সময় কাঠের তৈরি চেয়ার-টেবিল, খাট-পালং, সোফা-আলমারি, আলনা-ওয়ারড্রব ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য এসব গৃহ সামগ্রীকেই বোঝাত। আর আসবাবের মূল কাঁচামাল ছিল কাঠ। আর এ কাঠ সংগৃহীত হতো বন-জঙ্গল থেকে যা প্রকৃতি আমাদের দিয়েছিল অকৃপণ হাতে। প্রকৃতির এই অবারিত সরবরাহের কারণে আমাদের কখনোই কাঠ জোগাড় করতে বেগ পেতে হয়নি, না মূল্যের দিক থেকে না পরিমাণের দিক থেকে। আর এসব কাঠ প্রকৃতিগত ভাবেই ছিল অত্যন্ত মজবুত, পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং ঋতু তারতম্যের কারণে বাড়া-কমার দোষমুক্ত। তাই এসব ফার্নিচার ব্যবহৃত হতো যুগের পর যুগ, হস্তান্তরিত হতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কিন্তু নির্বিচারে কাঠ সংগ্রহের কারণে কমতে থাকে সরবরাহ। ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয়ে উঠায় কাঠের ফার্নিচারের ব্যবহার কমতে থাকে। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বাড়তে থাকে ফার্নিচারের চাহিদা। ফলে তৈরি হয়েছে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য। যা পূরণ করছে বিকল্প কাঁচামালের তৈরি ফার্নিচার। বিকল্প এসব কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে স্টেইনলেস স্টিল ও মেটাল সিট, স্টেইনলেস স্টিল ও মেটাল টিউব, প্লাস্টিক, পার্টিক্যাল বোর্ড, মিডিয়াম ডেনডিসটি ফাইবার (এমডিএফ) বোর্ড, ল্যাকার্ড, ট্রিটেড ৬৬ ইত্যাদি। কাঠের বিকল্প হিসেবে এসব কাঁচামাল দিয়ে তৈরি ফার্নিচার দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ সৌন্দর্য, স্থায়িত্ব বহন ও স্থানান্তরে সুবিধা, কম স্পেসে বেশি ফার্নিচার ব্যবহারের সুযোগ – এসব কারণেই এগুলোর দিকে মানুষ বেশি ঝুঁকছে। এই ভাবেই গড়ে উঠেছে বর্তমান ফার্নিচার শিল্প।
বর্তমান হালচাল
কিছুদিন আগেও আসবাবপত্র শিল্পকে বলা হতো কুটির শিল্প। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন এটি দেশের সমৃদ্ধ শিল্পে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে এই শিল্প থেকে অভ্যন্তরীণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা বাজারের চাহিদা পূরণ করছে। বাংলাদেশে এই শিল্পের বাজার এখন প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার। অন্যদিকে প্রতিবছর বিদেশ থেকে আরও প্রায় হাজার কোটি টাকার ফার্নিচার আমদানি করা হয়। এই সেক্টরে ছোট-বড় মিলে ৫০ হাজার উদ্যোক্তা রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। আর ১২ থেকে ১৫টি বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মূলত এই প্রতিষ্ঠানগুলোই ফার্নিচার রফতানি করে আসছে। বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির তালিকাভুক্ত রয়েছে মাত্র ৫৭০টি প্রতিষ্ঠান। রফতানি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে অটবি, আকতার ফার্নিশার্স, নাভানা, হাতিল, পারটেক্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এ খাতে বর্তমানে প্রবৃদ্ধি রয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। ২০০৭ সালে মাত্র ১৮ লাখ মার্কিন ডলারের রফতানি ২০১২ সালে পৌঁছে যায় প্রায় আড়াই কোটি ডলারে। একইভাবে দেশে ফার্নিচার কারখানাও বেড়েছে কয়েকগুণ।
এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের মতে, যদি পরিকল্পনামাফিক ফার্নিচার শিল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তবে রফতানি আরও কয়েকগুণ বেশি করা সম্ভব। ফলে গার্মেন্টের মতো ফার্নিচার শিল্প বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প হিসেবে গড়ে উঠবে। তারা অভিযোগ করে, ফার্নিচার শিল্পকে এখনও অনেক ক্ষেত্রে প্রোপার ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে ভাবা হয় না। তাই এই শিল্পের বিকাশে প্রথমেই প্রয়োজন স্বীকৃতি। একটি শিল্পের জন্য যেসব নীতিসুবিধা থাকা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে হবে। দিতে হবে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা। এছাড়া একটি আলাদা শিল্পনগরী স্থাপনের দারি রয়েছে তাদের।
বাংলাদেশের ফার্নিচার শিল্পের মোট উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ ফার্নিচার তৈরি হচ্ছে বিকল্প কাঁচামাল থেকে। দেশীয় কাঠ আর আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে যে শিল্প গড়ে উঠেছে তাতে সংযুক্ত রয়েছে ৫ হাজার প্রতিষ্ঠান। আর এতে জড়িত রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক। এর সঙ্গে কৃষকদের একটি অংশও জড়িত গাছ, বাঁশ, বেতসহ প্রয়োজনীয় বনজ কাঁচামাল উৎপাদনের মাধ্যমে। পুঁজির জোগান নিশ্চিত, কাঁচামাল আমদানি সহজ ও রফতানির সুযোগ সৃষ্টিসহ ফার্নিচার শিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ পেলে এ শিল্প হতে পারে কর্মসংস্থানের এক নতুন দিগন্ত। একই সঙ্গে হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সম্ভাবনাময় খাত।
স্থানীয় বাজার ও রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে ফার্নিচার শিল্প আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাছাড়া এই শিল্পে সরাসরি ২৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে যা আমাদের অর্থনীতির সূচকের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সস্তা শ্রমের কারণে অনেক বেশি ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করা সম্ভব। এগুলো তৈরি করা গেলে আরো অনেক লোকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব হবে। এই শিল্পের যত প্রসার ঘটবে তত জনবল প্রয়োজন হবে যা বেশি পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং চীন ও মালয়েশিয়ার মত বাংলাদেশও বিশ্ববাজারে রপ্তানি বাজার দখল করতে পারবে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ১২ টি দেশে সরাসরি ফার্নিচার রপ্তানি করছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি,ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ফার্নিচার রপ্তানি করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব বাজারের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ অত্যন্ত কম। বর্তমান বিশ্বে আসবাবপত্র শিল্পের বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করছে মাত্র আড়াই কোটি ডলারের আসবাবপত্র। কিন্তু প্রায় এক হাজার কোটি ডলারের ফার্নিচার রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। একই সাথে এই শিল্প অভ্যন্তরীণ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাজারের চাহিদা পূরণ করছে। এই শিল্পকে যদি পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তবে রপ্তানি আরো কয়েকশগুণ বেশি করা সম্ভব। এরফলে গার্মেন্টস এর মত ফার্নিচার শিল্প বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প হিসাবে গড়ে উঠবে। এই শিল্পের কাঁচামাল কিছু দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয় আবার কিছু বিদেশ থেকেও আমদানি করতে হয়। আমাদের দেশে গাছের যোগান কম তাই বিদেশ থেকে পার্টিকেল বোর্ড, এম ডি এফ, প্লাইউড আমদানি করতে আমাদের উৎসাহিত করা হয়। তবে, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হলেও এটা বনজ সম্পদ রক্ষা করার জন্য একটি ইতিবাচক দিক। এই পার্টিকেল বোড, এম ডি এফ, প্লাইউড আমদানী করা না হলে আমাদের প্রতিবছর কয়েক কোটি গাছ কাটতে হতো। এই শিল্পকে সার্পোট করার জন্য অনেক ছোট ছোট ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন রয়েছে। যদি এগুলোকে ক্লাস্টার ফরমেশনে আনা যায় তবে সার্পোটিং মেটেরিয়্যালগুলো আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ঘটাবে।
সম্ভাবনা
বিশ্বের বড় বড় বায়ার আগে চীনের বাজার থেকে ফার্নিচার ক্রয় করত। কিন্তু সেখানে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও অনেক বেড়েছে। এ কারণে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চীন থেকে ফার্নিচার কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তারা এখন বাংলাদেশের বাজারের দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে এ শিল্পের সামনে সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে আসবাবপত্র শিল্পের বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশ এখন বছরে মাত্র আড়াই কোটি ডলারের আসবাবপত্র বিদেশে রফতানি করছে। কিন্তু প্রায় এক হাজার কোটি ডলারের ফার্নিচার রফতানির সুযোগ রয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা
দেশের ফার্নিচার শিল্প বিকাশ হলেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি অনেকটা কমে গেছে। কারণ, দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন ফার্নিচার কিনছে কম। এ কারণে ফার্নিচার শিল্প অনেকটা রফতানি নির্ভর হয়ে পড়ছে।
সরকারি সহযোগিতা
সরকার ফার্নিচার শিল্পের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে যার প্রমাণ জাতীয় বাজেট। সরকারকে ফানির্চার শিল্পের জন্য রেখেছে রপ্তানিকর রেয়াত সুবিধা। এছাড়া পার্টিকেল বোর্ড যা ফার্নিচার শিল্পের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তা দিয়ে ফার্নিচার রপ্তানির জন্য শুল্ক কমিয়ে সরকার এই ফার্নিচার শিল্পের জন্য বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এরফলে ফার্নিচার শিল্পের উদ্যোক্তারা বেশি পরিমাণ ফার্নিচার রপ্তানি করার সুযোগ পায়, যা আমাদের অর্থনীতিতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গত কয়েক বছর ধরেই সরকার এই শিল্পকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে। এই ফার্নিচার শিল্পের যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা ফার্নিচার শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ফার্নিচার রফতানিতে সরকার নগদ অর্থ সহায়তা দেবে। তিনি বলেন, রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণ এবং বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি যেসব পণ্য রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, ফার্নিচার এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ফার্নিচার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ব্যবসায়ীদের পরামর্শ মোতাবেক নগদ অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ফার্নিচার শিল্পের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশের তৈরি ফার্নিচার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানিতেও অবদান রাখছে। এ জন্য সরকার এ শিল্পের বিকাশে রফতানি প্রণোদনাসহ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে।
মেড ইন বাংলাদেশ
১৯৯৭ সাল থেকে আসবাব বিদেশে রফতানি হচ্ছে । এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশের স্বনামধন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। আসবাব রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্নিচার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফইএ) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে সরাসরি ফার্নিচার রফতানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। অটবি, আকতার ফার্নিচার্স, নাভানা, হাতিল, প্যাসিফিকসহ ১২টি প্রতিষ্ঠান বিএফইএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আসবাব রফতানি করছে। এ ছাড়া আরও ১০টি প্রতিষ্ঠান রফতানির সঙ্গে জড়িত।
Leave a Reply