জনাব সভাপতি সাহেব এবং সমবেত সুধীবৃন্দ,
আসসালামু আলাইকুম। আজ জাতীয় জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে নিখিল বাংলাদেশ মুসলিম সম্মেলন সন্তোষের এতো এক ঐতিহাসিক জায়গায় অনুষ্ঠিত হইতেছে। যেসব মুসলিম মনীষীর মানবকল্যাণধর্মী নিঃস্বার্থ কাজের মাধ্যমে ইসলাম দিগদিগন্তে বিস্তার লাভ করিয়াছিল, হযরত পীর শাহ জামান তাঁহাদের অন্যতম। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে সম্রাট আওরঙ্গজেব কাগমারী পরগনার সনদ দিয়াছিলেন এই মনীষীকে; সনদের উদ্দেশ্য ছিল কাগমারী হইতে ইসলাম প্রচার এবং ইসলামের কল্যাণধর্মী রূপকে সাধারণ মানুষের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণমূলক কাজের ব্যবস্থা করা। কাগমারী পরগনার অন্তর্ভুক্ত এই সেই সন্তোষ যার সাথে জড়িত রহিয়াছে হযরত শাহ জামানের পুণ্য স্মৃতি; এই সেই সন্তোষ যা সেই মহান মনীষীর অসংখ্য জনহিতকর কাজের সাক্ষর বহন করিতেছে। হযরত শাহ জামান ছিলেন সত্যিকার অর্থে জনদরদী; সব মানুষের কল্যাণচিন্তাই ছিল তাঁহার ইসলাম প্রচারের মূল প্রেরণা। ইসলামের এই কল্যাণধর্মী রূপে আকৃষ্ট হইয়া অনেক বিধর্মী ইসলামের শান্তি-শীতল ছত্রছায়ায় আপনাদের স্থান করিয়া নিয়াছিল। যাহারা ইসলাম গ্রহণ করে নাই তাহাদের জন্যও হযরত শাহ জামানের সেবার হস্ত থাকিত সদাই প্রসারিত। তাঁহার এই সেবাসুন্দর চরিত্রের মাধুর্যের দ্বারা তিনি হিন্দু-মুসলমান সবার কাছেই সমভাবে শ্রদ্ধাভাজন হইতে পারিয়াছিলেন। এখনও তাই হযরত শাহ জামানের মাজার হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীর কাছে সমানভাবে প্রিয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই পরম সহনশীল পুণ্যাত্মার মন্ত্রে দীক্ষিত মুসলমানেরা নিরুপদ্রবে বসবাস করিতে পারে নাই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক হইতে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবনের উপর হামলা আসিয়াছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত আসিয়াছে তাহা সন্তোষের অতীত অনেক ঘটনাকে স্মৃতির পর্দায় জীবন্ত করিয়া তোলে। পীর শাহ জামান মনোনীত কাগমারী পরগনার প্রথম মুতত্তাল্লি হযরত শাহ জামানের পালকপুত্র শাহ এনায়েত উল্লাহকে হত্যা করিয়া মুসলমানদের তাহজীব-তমদ্দুনকে ধ্বংস করিয়া দিবার যে জঘন্য প্রচেষ্টা করা হইয়াছিল, তাহা এতদঞ্চলের লোক আজও ভুলিতে পারে নাই। যে অশুভ চক্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবনকে ধ্বংস করিয়া দিতে ছিল বদ্ধপরিকর, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরিয়া সেই চক্র আবার তৎপর হইয়া ওঠে এবং মুসলমানদের তাহজীব-তমুদ্দনের উপর হানে ছোবলের পর ছোবল। এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আমি বাংলাদেশের মুসলমান ভাইদের যথাসময়ে সতর্ক করিয়া দিয়েছিলাম। আমি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছিলাম যে, বাংলাদেশের মুসলমানরা অন্যান্য ধর্মালম্বীর সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে চায়। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে তাহারা তাহাদের তাহজীব-তমুদ্দুনের উপর কোনো প্রকার আঘাত মুখ বুজিয়া সহ্য করিবে। আমার সতর্কবাণী বাংলাদেশের মুসলমানদের ঘরে ঘরে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তাহার আপাতদৃষ্টিতে এই ষড়যন্ত্র স্তিমিত হইয়াছে মনে হইলেও আসলে কুচক্রিরা নিপুণ ঘটনা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে মুসলিম তাহজীব-তমুদ্দুনের শত্রুরা নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া নাই। যে বাংলাদেশের মাটিতে শতকরা ৮৬ ভাগ লোক মুসলমান যেখানে মুসলমানদের নয়নের মনি বুকের ধন রাসূলে করিম (সা:) সম্বন্ধে আপত্তিকর এবং অশোভন উক্তি প্রকাশের দুঃসাহস দেখিতে পাওয়া যায়। যে কবির কবিতায় এইরূপ উক্তি স্থান পাইয়াছে সে একটি বিরাট চক্রের ক্রীড়নক মাত্র। কবির উক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে ঝড় উঠিয়াছিল তাহা খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু ভাইসব, আমাদের ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা উচিত যে এই কবিতা প্রকাশনার অন্তরালে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সক্রিয় রহিয়াছে। কবিতা প্রকাশ করিয়া এই ষড়যন্ত্র তাহজীব-তমুদ্দুনের প্রতি বাংলার মুসলমানদের মনোবল যাচাই করিতে চাহিয়াছিল। এই ধরনের অপচেষ্টার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবার জন্য আজ আমাদের সকলকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। আমরা যাহাতে আমাদের তাহজীব-তমুদ্দুন অক্ষুন্ন রাখিতে পারি এবং আমাদের আদর্শে হিমাচলের এতো অটল থাকিতে পারি তাহার জন্য আমাদের কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করিতে হইবে। এইরূপ কর্মপন্থা উদ্ভাবন এবং কর্মসূচি প্রণয়ন এই সম্মেলন আহ্বানের সীমিত উদ্দেশ্য।
এই সম্মেলনের বিশেষ উদ্দেশ্য হইল শাস্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের বিপ্লবী রূপকে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলিয়া ধরা। ইসলামি বিপ্লবের উজ্জ্বল আলোকাভা তমাসাচ্ছন্ন বিশ্বকে যেভাবে উদ্ভাসিত করিয়াছিল তাহার প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণের প্রয়োজন আজ বিশেষভাবে দেখা দিয়াছে। নির্যাতিত মানবতার কল্যাণ কামনায় রসূলে করিম (সা.) যে ইসলামি বিপ্লবের বীজ রোপণ করিয়াছিলেন, অতি অল্পকালের ভিতরই তাহা ফুলে-ফলে সুশোভিত হইয়া ওঠে। এত অল্প সময়ে আজ পর্যন্ত কোনো বিপ্লবই ইসলামি বিপ্লবের এতো এমন পূর্ণাঙ্গরূপে আত্মপ্রকাশ করিতে পারে নাই। অথচ মাত্র ৩০ বছরের এতো এই বিপ্লবের ব্যাপ্তি। যে বিপ্লব মানবগোষ্ঠীর কল্যাণ ও শান্তির জন্য এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করিয়াছিল, স্বল্পকালের ব্যাপ্তিতে সেই দ্বার রুদ্ধ হইয়া গেল কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে হইলে ইসলামি বিপ্লবের স্বরূপের উপর একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। ইসলামের কলেমার ভিতর নিহিত রহিয়াছে ইসলামি বিপ্লবের মূল মন্ত্র। আল্লাহ ছাড়া নাই কোনো উপাস্য; সুতরাং সব কিছুর উপর সার্বভৌমত্ব রহিয়াছে একমাত্র আল্লাহর। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করিয়া ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছিল কলেমার শাশ্বত বাণী। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্ত সম্পদের মালিকানা আল্লাহর উপর ন্যস্ত করিয়া ইসলামি বিপ্লব সর্বপ্রকার শোষণের অবসান ঘটাইতে সমর্থ হইয়াছিল। অর্থ এবং সম্পদের সুষম বণ্টনও নিশ্চিত করিয়াছিল ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠায় যে নীতি ইসলামী বিপ্লবকে এক নতুন বৈশিষ্ট্যে বলিয়ান করিয়াছিল তাহা হইল ইসলামের পালনবাদ। ইসলামের মূল কথা হইল স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস এবং স্রষ্টাকে লালন-পালন এবং বিবর্তনকর্তা হিসাবে গ্রহণ করা। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুকে স্রষ্টা যেমন লালন-পালন করেন, তেমনি তিনি লালন-পালন করেন সৃষ্টির অভিজাত মানুষকেও। মানুষ সৃষ্ট হইয়াছে স্রষ্ট্রার প্রতিভূ হিসাবে তাই মানুষ তাহার দৈনন্দিন জীবনযাপনেরও হইবে পালনবাদের অনুসারী। রাষ্ট্রীয় শাসনবাদকে করিবে পরিহার। একটি পরিবারে পিতা যেমন সন্তান-সন্ততিদের অভাব-অনটন অনুযায়ী সব কিছুর ব্যবস্থা করিয়া তাহাদের প্রতিপালন করিয়া থাকেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিগণও রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা প্রবর্তন করিবেন। সন্তান- সন্ততি প্রতিপালনে পিতা এবং সন্তানদের ভিতর প্রেমপ্রীতির যে জীবনকে ঘিরিয়া থাকিবে। শাসন করিয়া অন্যকে আদেশ প্রতিপালন করানো যাইতে পারে, কিন্তু তার ফল খুব শুভ হয় না। আন্তরিকভাবে স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কোনো কিছুকে গ্রহণ করিতে না পারিলে বাহ্যিক চাপ শুধু সমস্যারই সৃষ্টি করে। শাসনবাদে যে কর্তৃত্বের অহমিকা রহিয়াছে তাহা মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিতর ফাটল সৃষ্টি করিয়া থাকে। শাসিত শাসককে দেখে সন্দেহের চোখে, সুযোগ পাইলেই শাসনের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদে মুখর হইয়া ওঠে। ইসলামে তাই শাসনবাদের কোনো স্থান নাই। প্রতিপালনের প্রীতিপূর্ণ মধুময় রসে ইসলামি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আপুত- যেখানে নাই শাসিত ও শাসনের ব্যবধান। রবুবিয়াত অর্থাৎ পালনবাদের প্রতিষ্ঠা ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান লক্ষ।
পালনবাদকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সফল করিয়া তুলিতে পারিলে, পালনবাদের অন্তর্নিহিত ভাবধারাকে সম্যকভাবে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করিয়া লইয়াই আমরা যখন মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে প্রয়াসী হইব, তখন আমার আমিত্বকে খর্ব করিবার প্রয়োজন দেখা দেয় অনেক ক্ষেত্রে। নফসানিয়াত এবং রুহানিয়াতের ভিতর সুসংহত সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমেই পালনবাদকে মানুষের জীবনে সফল করিয়া তোলা সম্ভব। নফসানিয়াত যখন প্রবল হইয়া ওঠে তখন মানুষ নিজেদের স্বার্থবুদ্ধিতে পরিচালিত হইয়া অন্যের স্বার্থকে দলিত মথিত করিতে দ্বিধা করে না। আজ সারা বিশ্বের মানুষ “শান্তি শাস্তি ” বলিয়া চিৎকার করিতেছে; কিন্তু শান্তির প্রতিষ্ঠা হইতেছে না কেন? একটু বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে যে এখানেও নফসানিয়াত সুকৌশলে কাজ করিয়া যাইতেছে। আমেরিকা চায় আমেরিকার এতো করিয়া শান্তি। অপরপক্ষে, রাশিয়া শান্তিকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চায় রুশদের দৃষ্টিকোণ হইতে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্বার্থ দেশগত স্বার্থে রূপান্তরিত হইয়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করিতেছে। আমরা যদি ভুলিয়া যাইতে পারিতাম ব্যক্তিগত অথবা দেশগত স্বার্থকে, আমরা যদি গ্রহণ করিতে পারিতাম পালনবাদের স্বভাবসুন্দর নীতি, তাহা হইলে শাস্তি হয়তো সুদূরপরাহত হইত না। ইসলাম মানব-প্রকৃতির ধর্ম। তাই মানবিক কোনো প্রবৃত্তির উৎখাতে ইসলাম বিশ্বাস করে না। মানব-প্রকৃতির সার্বিক কল্যাণের বিরোধী যে সব প্রবৃত্তি, তাহাকে এমনভাবে সুসংহত এবং সুসংযত করিতে হইবে যে, তাহা যে কল্যাণবিরোধী না হইয়া কল্যাণকামী হয়। মানুষের প্রকৃতির ভিতর নিহিত রহিয়াছে বিপরীতধর্মী প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব। তাই কখনও ভোগবিলাসের প্রবৃত্তিগুলো প্রাধান্যলাব করে এবং তাহার ফলে মানুষ হইয়া পড়ে নফসানিয়অতের প্রাধান্য অর্থাৎ ভোগবিলাসের আকাঙ্ক্ষাই যতসব শোষণের মূল। নফসানিয়অতকে সুসংহত এবং সুসংযত করিয়া মানবকল্যাণে তাহা নিয়োগ করা সম্ভব। এক কথায়, নফসানিয়াত এবং রুহানিয়অতের পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য বিধানের মধ্যে নিহিত রহিয়াছে মানবকল্যাণের প্রকৃষ্ট পথ। রসুলে করিম (সা.) তাঁহার বিপ্লবে মানুষের নফসানিয়অতকে সুসংহত এবং সুসংযত করিয়া নফসানিয়াত এবং রুহানিয়াতের ভিতর সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই ইসলামের অনুসারীরা সেদিন মানবকল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং নিজের জীবনে আদর্শের রূপায়ণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল বিপ্লবী সমাজব্যস্থা কায়েমে। তাঁহার অন্তরঙ্গ সাহাবাদের আদর্শের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা ইসলামী বিপ্লবের ধারাকে অব্যাহত রাখিতে পারিয়াছিল। কিন্তু তাহার পর ইসলামের আকাশে নামিয়অ আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। নফসানিয়াত বিস্তার করে তাহার আপন প্রাধান্য। নফসানিয়অতের প্রাধান্যের সাথে সাথেই ইসলামের কল্যাণধর্মী রূপের সমাধি রচিত হয়। ইসলামি বিপ্লবকে আবার তাহার পূবাবস্থায় ফিরিয়া পাইতে হইলে এমন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করিতে হইবে যাহার সাহায্যে নফসানিয়াত এবং রুহানিয়াতের ভিতর সামঞ্জস্য স্থাপন করা যায়। এমন কর্মসূচি আমাদের গ্রহণ করিতে হইবে যাহার মাধ্যমে স্রষ্টাতে আত্মসমর্পণ আমরা নতুন বলে বলীয়ান হইতে পারি। বৈষয়িক উন্নতির উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ না করিয়া আত্মিক উন্নতিতেও আমাদের হইতে হইবে সমৃদ্ধ। সন্তোষে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এই উদ্দেশ্যের দ্বারাই অনুপ্রাণিত।
নফসানিয়াতের প্রাধান্য এবং ভোগবিলাসের আকাঙ্খা শোষণের জন্য দায়ী। সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার মোহও সৃষ্টি হয় নফসানিয়অতের প্রাধান্য হইতে। আল- কোরআন তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে যে, সমস্ত সম্পদের মালিক আল্লাহ। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ শুধুমাত্র সম্পদের সুষম বণ্টনের দায়িত্বভার গ্রহণ ও পালন করেন। এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ভোগবিলাসের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত করিয়া কল্যাণধর্মী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয়। শোষকের কোনো স্থান নাই ইসলামে। শোষকের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হইয়াছে আল-কোরআনে। একদিকে যেমন শোষকদের বিরুদ্ধে সুসংহত প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিতে হইবে, অন্যদিকে তেমনি এমনভাবে মানুষকে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যে তাহারা যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে কোনো প্রকারের শোষণকে ঘৃণা করিতে শিখে। তাহা ছাড়া সমাজ জীবনে এমন অবস্থার সৃষ্টি করিতে শিখে। তাহা ছাড়া সমাজজীবনে এমন অবস্থার সৃষ্টি করিতে হইবে যাহাতে শোষকরা নিজেদের পথকে ভ্রান্ত বলিয়া উপলব্ধি করিবার শিক্ষালাভ করে, শোষকরা যাহাতে নিজেদের শোধরাইয়া লইতে পারে, তাহার পথও খোলা রাখিতে হইবে। এই পন্থায় শোষণ রোধ করিতে পারিলে সমাজ বা রাষ্ট্রীয়জীবন প্রেমপ্রীতি এবং ভালোবাসা সঞ্চিত হইবে।
অধুনা আমরা যে অর্থে শ্রেণি-সংগ্রামের কথা বলিয়া থাকি, সেইরূপ কোনো শ্রেণি- সংগ্রাম নাই ইসলামের। যে কোনো প্রকারের একনায়কত্ব হিউক না তাহার সর্বহারাদের) সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। আজকাল যে শ্রেণি-সংগ্রামের কথা আমরা বলিয়া থাকি তাহা শুধু হিংসা এবং দ্বেষ-প্রবৃত্তিকে প্রদীপ্ত করিয়া থাকে। ইসলামের যে শ্রেণি-সংগ্রাম তাহা হইল শোষক ও শোষিতের সংগ্রাম। শোষকের বিরুদ্ধে নয় সারা বিশ্বে শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হইলে আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত শাস্তি স্বেচ্ছায় আমাদের দুয়ারে আসিয়া উপস্থিত হইবে।
[ প্রকাশকাল: ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০ চাবুক, মওলানা ভাসানী সংখ্যা]
Leave a Reply