সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে ১৬ বছরের একছত্র রক্ষণশীল শাসনের অবসান হল জার্মানিতে। জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হল আঙ্গেলা ম্যার্কেলের কনজারভেটিভ পার্টি। তার সরকারেরই একদা-জোটসঙ্গী হিসেবে থাকা ওলাফ স্কল্জের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসডিপি) এই নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। অ্যাঙ্গেলা মর্কেলের দল ২৪.১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অন্য দিকে, এসডিপি পেয়েছে ২৫.৭ শতাংশ। পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী রাজনীতি থেকে বিদায় নিচ্ছেন অ্যাঙ্গেলা মর্কেল। বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধরদের মঞ্চ থেকে ব্যক্তি অ্যাঙ্গেলা মর্কেলের বিদায় নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস্ বিশ্বাস।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী
২০০৫ সাল থেকে জার্মান চেন্সেলার আঙ্গেলা ম্যার্কেল। তিনি দেশটির প্রথম নারী চ্যান্সেলর। ১৯৯০ সালে, দুই জার্মানি তখন এক হওয়ার পথে। সে বছরই ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) দলে যোগ দেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। দলের সাধারণ সদস্য থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য, তারপর মন্ত্রী, সিডিইউ দলের প্রধান এবং চ্যান্সেলর – এত অর্জন ধরা দিতে সব মিলিয়ে ১৫ বছরও লাগেনি। যখন প্রথমবার চান্সেলার নির্বাচিত হলেন অনেকের মনেই সংশয় ছিল – এমন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন তো?
ব্যক্তিত্ব আর নেতৃত্বগুণে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। আঙ্গেলা ম্যার্কেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যে অগ্রগনী ভূমিকা রেখেছিলেন তাতে তাঁর প্রতি সমগ্র ইউরোপবাসীর আস্থা ছিল অনেক বেশি। গত কয়েক বছরের বেশ কিছু কাজ, বিশেষ করে সিরিয়ার উদ্বাস্তু সমস্যা আর গ্রিসের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে তার কার্যকরী দিকনির্দেশনা বিশ্লেষকদের চোখে পৃথিবীর ক্ষমতাধরদের তালিকায় তিনি এক নম্বর। তার অনুসারীরা ডাকেন ‘মাম্মি’ নামে।
টানা ১০ বছর ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীর আসনে থাকা লৌহমানবী হিসেবে খ্যাত জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতীকীভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। দলে, সরকারে, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে নারীদের বসানোর ক্ষেত্রে তার দৃঢ় ভূমিকা ছিল।
সেক্সিজম’ এবং ‘পুরুষের উদ্ভট আচরণ’ সামলানোয় দক্ষতার কারণে মের্কেল পরে বিশ্বজুড়ে নারীদের বিপুল সম্মান পেয়েছেন। পুরুষরা প্রাধান্য বিস্তার করছে- বিশ্বনেতাদের এমন মঞ্চেও মের্কেল শেষ পর্যন্ত ঠিকই নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তবে সবসময়ই যে ডানপন্থি রক্ষণশীদের দলের এই নেত্রী নারী-পুরুষ সমান অধিকার নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তেমনও নয়।
আঙ্গেলা ডোরোটেয়া মের্কেল
১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই পশ্চিম জার্মানির হ্যামবুর্গে আঙ্গেলা ডোরোটেয়া ম্যার্কেল জন্মগ্রহণ করেন। মা ছিলেন শিক্ষক, বাবা প্রোটেস্টান যাজক। শৈশবে তিনি পল্লী অঞ্চলে বড় হয়েছিলেন। তখনকার সময়ে অধিকাংশ শিশুদের মত মের্কেলও জার্মানির সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির নেতৃত্বাধীন জার্মান মুক্ত তরুণ নামক তরুণ-আন্দোলনের সদস্য ছিলেন। তিনি এই সংগঠনের সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব ছিলেন।
আঙ্গেলা ম্যার্কেল টেম্পলিন শহরের একটি স্কুলে পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি লাইপৎসিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান পড়েন। শিক্ষার্থী থাকাকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম চালুর দাবিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বার্লিনে অবস্থিত জার্মান বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিতে ভৌত রসায়ন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নেন এবং এখানেই তার কর্মজীবন শুরু করেন। সেসময় তিনি রুশ ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে শিখেছিলেন। কোয়ান্টাম রসায়নের উপর গবেষণার জন্য তাকে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করা হয়। এরপর তিনি এখানে গবেষক হিসেবে কাজ করেন।
ব্যক্তিজীবনে সহপাঠী উলরিশ ম্যার্কেলকে বিয়ে করেন। চার বছর পরই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাঁদের। তবে স্বামী গেলেও তাঁর পদবিটি রেখেছেন সঙ্গে। পরবর্তীতে বিয়ে করেন কোয়ান্টাম রসায়নবিদ অধ্যাপক ইওয়াখিম সাওয়ারকে। এ দম্পতি নিঃসন্তান।
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের অবসর ভাতা
গত জুলাইয়ে ৬৭ বছর পূর্ণ করেছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। চ্যান্সেলর হিসেবে মাসিক ২৫ হাজার ইউরো ভাতা পাচ্ছিলেন তিনি৷ সেই সঙ্গে সংসদ সদস্য হিসেবে ১০ হাজারের বেশি আয়ও রয়েছে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সংসদে সক্রিয় রয়েছেন। সেই কাজের শেষে তিন মাস পর্যন্ত সংসদ হিসেবে পূর্ণ ভাতা পাবেন। তারপর সর্বোচ্চ ২১ মাস পর্যন্ত সেই অংকের অর্ধেক পেতে পারেন।
চ্যান্সেলর, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবে ম্যার্কেলের দীর্ঘ কার্যকালের সুবাদে প্রাপ্য অবসর ভাতার মধ্যে সমন্বয় করে বর্তমান জার্মান আইন অনুযায়ী আঙ্গেলা ম্যার্কেল শেষ পর্যন্ত মাসে ১৫ হাজার ইউরোর মত অবসর ভাতা পেতে পারেন। তাছাড়া আজীবন দেহরক্ষী ও চালকসহ সরকারি গাড়িও পাবেন তিনি। বুন্ডেস্ট্যাগ (জার্মানির পার্লামেন্ট) ভবনে বেশ কয়েকজন কর্মীসহ নিজস্ব একটি দফতর তার জন্য বরাদ্দ থাকবে।
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের অবসর পরিকল্পনা
গত জুলাই মাসে ওয়াশিংটন সফরের সময় আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে তার অবসর জীবনের পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল৷ সাধারণত এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও সে বার তিনি বলেছিলেন, সবার আগে কিছুদিন বিরতি চান তিনি। তার পর অন্যদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার কথা ভাববেন।
কাজ থেকে অবসর পেয়ে ম্যার্কেল নিজের আগ্রহ সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা করতে চান। বিগত ১৬ বছরে তিনি সেই লক্ষ্যে তেমন সুযোগ পান নি৷ মুচকি হেসে তিনি আরও বলেন, হয়তো বই পড়ার চেষ্টা করবেন, ক্লান্তি কাটাতে একটু বেশি ঘুমাবেন। ম্যার্কেলের ভাষায় ‘‘তারপর দেখা যাক, কোথায় আবার উদয় হই।”
জার্মানিতে সরকারের প্রাক্তন সদস্যদের গোপনীয়তার শপথ মেনে চলতে হয়। সে সব কথা পেটে রাখতে হলেও পরামর্শদাতা এবং রাজনৈতিক আঙিনায় অসংখ্য যোগাযোগের সুবাদে এমন ব্যক্তিরা শিল্পবাণিজ্য জগতে বেশ জনপ্রিয়৷ আঙ্গেলা ম্যার্কেলের কয়েকজন পূর্বসূরি বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। যেমন হেলমুট স্মিট ১৯৮২ সালে সাপ্তাহিক ‘ডি সাইট’ পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কোনো লেকচারের জন্য তিনি ১৫,০০০ ডলারের কম পারিশ্রমিক না নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
হেলমুট কোল ও গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার প্রাক্তন চ্যান্সেলর হিসেবে স্মিটের তুলনায় আরও বেশি আয়ের মুখ দেখেছেন। কোল রাজনীতি ও স্ট্র্যাটেজিক সংক্রান্ত পরামর্শ দিতে নিজেই একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। লবিয়িং করে ও পরামর্শ দিয়ে তিনি মোটা অংকের আয় করেছেন।
প্রাক্তন চ্যান্সেলর হিসেবে গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০০৫ সালে কার্যকালের কয়েক মাস পরেই নর্ড স্ট্রিম নামের পাইপলাইন কোম্পানির হয়ে আসরে নেমে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন৷ চ্যান্সেলর হিসেবে রাশিয়ার গাজপ্রম কোম্পানির এই প্রকল্পের হয়ে তদ্বির করে তার পরেই সেই কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত দৃষ্টিকটু৷ সেই ঘটনার পর আইন প্রণয়ন করে স্থির করা হয়েছে, যে জার্মানির কোনো প্রাক্তন চ্যান্সেলরকে নতুন কাজ নেবার আগে চ্যান্সেলর দফতরে জানাতে হবে৷ প্রস্তাবিত সেই ভূমিকা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষূণ্ণ করতে পারে কিনা, এক এথিক্স কমিটি সরকারকে সে বিষয়ে পরামর্শ দেবে৷ তেমন আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার ১৮ মাস পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।
আপাতত আঙ্গেলা ম্যার্কেল বার্লিনেই থাকবেন বলে মনে হচ্ছে৷ কারণ তার স্বামী ইওয়াখিম সাউয়ার কোয়ান্টাম রসায়নের প্রোফেসর হিসেবে এখনো কাজ গুটিয়ে আনার কথা ভাবছেন না। ৭২ বছর বয়সি সাউয়ার আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিলেও আপাতত ২০২২ সাল পর্যন্ত বার্লিনের হুমবল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র রিসার্চার হিসেবে চুক্তিবদ্ধ রয়েছেন।
ব্যক্তি হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল কিছু পদ রান্না করতে ভালোবাসেন৷ যেমন আলুর স্যুপ ও প্লাম কেক৷
প্রথম প্রতিবাদ
দুই জার্মানির পুনর্মিলনের পর গঠিত প্রথম মন্ত্রীসভায় নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য পূর্ব জার্মানির কাউকেই খুঁজছিলেন চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল। পুর্ব জার্মানির শেষ প্রধানমন্ত্রী লুথার ডি মেইজার সুপারিশ করলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেলের নাম। ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করে চ্যান্সেলরের সুনজরে আসেন তিনি। ১৯৯৮ সালে নির্বাচনে কোহলের নেতৃত্বাধীন ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের ভরাডুবি মার্কেলের জীবনে নতুন মোড় আনে। তাকে পার্টির সেক্রেটারি জেনারেলের পদ দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে নভেম্বরে কোহলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অর্থনৈতিক কেলেংকারির অভিযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু কোহলের মতো প্রভাবশালীর নেতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কে? আশ্চর্যজনকভাবে সেই দায়িত্ব কাধে তুলে নিলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। নিজের রাজনৈতিক পিতার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ তিনিই শুরু করেন।
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের অনাড়ম্বর সাধারণ জীবন
পূর্ব জার্মানির মানুষ আঙ্গেলা ম্যার্কেল অনাড়ম্বর সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। ক্ষমতার শিখরে থেকেও তার জীবন অনাড়ম্বরই ছিল। একটি সাধারণ নিজস্ব গাড়ি ছাড়া তার ব্যক্তিগত প্লেন, ইয়ট এমনকি বিলাস বহুল কোনো এপার্টমেন্ট বা বাড়ি নেই। অন্যান্য ছাপোষা জার্মান নাগরিকের মত তিনি একটি অতি সাধারন এপার্টমেন্টে থাকেন, রাজনীতিতে আসবার আগে থেকেই।
অবিশ্বাস্য শোনালেও মার্কেলকে মানুষ একই পোশাকে আঠারো বছর ধরে দেখে এসেছে।
একটি প্রেস কনফারেন্সে একজন মহিলা সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, তার কি অন্য স্যুট নেই। আঙ্গেলা ম্যার্কেল উত্তরে বলেন তিনি রাজনীতিবিদ, মডেল নন।
অন্য একটি সন্মেলনে সাংবাদিকেরা জানতে চান, তিনি এত ব্যাস্ত, তার বাড়ির কাজ কে করেন? তার বাড়িতে কাজের লোক, রান্নার লোক আছে কি না। উত্তরে আঙ্গেলা ম্যার্কেল জানান, তার বাড়িতে একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ কাজের লোক আছে। মহিলাটি তিনি নিজে, এবং পুরুষটি তার স্বামী। সাংবাদিকেরা মজা করে জানতে চান, কাপড় জামা কে ধোয়? তিনি না তার স্বামী?
আঙ্গেলা ম্যার্কেল জানান, তিনি কাপড় জামা ওয়াশিং মেশিনে ঢোকান। সাবানের গুড়ো ঢেলে দেন। তার স্বামী মেশিন চালান। তারা রাতে ওয়াশিং মেশিন চালান, কারন এই সময় বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। এর পর সাংবাদিকদের তিনি জানান, তিনি আশা করবেন এ সব অবান্তর প্রশ্ন না করে সংবাদ মাধ্যম যেন তার সরকারের সাফল্য এবং ব্যার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করে।
Leave a Reply